জুঞ্জি ইতো: ৩০ বছের ধরে হরর ম্যাঙ্গা’র এক অনবদ্য স্রষ্টা
https://bd.toonsmag.com/2019/07/4324.html
মেয়েদের দৈনন্দিন মেকাপ ও প্রসাধনীর ব্যবহারকে বিশ্বজুড়েই প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে ব্যাঙ্গ করা হয়ে থাকে এবং প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহারকারী মেয়েদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশাও হয়ে থাকে। আবার গোটা বিশ্বজুড়েই নারীবাদীরা প্রতিটি মেয়েকেই নিজস্ব শারীরিক গড়ন ও সৌন্দর্য্য সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ় মানসিকতা সম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা ও অন্যান্য শিক্ষা প্রদান করছে। আর এসব কিছুর মাঝেই সমাজের মানুষের সামনে উপস্থিত হল এমন একটি নারী চরিত্র যে নিজের চেহারা ও অবয়বকে এতটাই অপছন্দ করে যে সে নিজেই পুরুষদেরকে তাকে হত্যা করতে বাধ্য করে। কারণ প্রতিবার মারা যাবার পরে সে ঐ মৃতদেহ থেকেই আবারো একটি নতুন রূপে নতুন জীবন নিয়ে ফিরে আসে। উল্লেখ্য, ঐ পুরুষদের সে নিজেই প্রথমে আকৃষ্ট করে এবং নিজের মৃত্যুকে যতটা সম্ভব নৃশংস করে তুলতেই উদ্বুদ্ধ করে। শুনতে অদ্ভুত লাগছে তাই না? কিন্তু জাপানী ভৌতিক ম্যাঙ্গা (এক ধরনের জাপানী কমিক) গল্পের শিল্পী ‘জুঞ্জি ইতো’ তার সৃষ্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পগুলির একটিতে ঠিক এমনটাই দেখিয়েছেন। আর ঐ অদ্ভুতুড়ে চরিত্রটির নাম ‘টমি’, এপর্যন্ত ইতো’র সৃষ্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র।
আরো পড়ুন: মীনা: সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তনকারী এক যুগান্তকারী চরিত্র
হরর ম্যাঙ্গা বা ভৌতিক ম্যাঙ্গা গল্পের জগতে, বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পীদের মধ্যে জুঞ্জি ইতো শীর্ষস্থানীয়। বিগত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এসকল গল্প ও চরিত্র তৈরি করে আসছেন যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাঠকদের বিনোদনের খোরাক যুগিয়েছে; আর, বলাই বাহুল্য যে সেই সাথে পাঠকদের নির্ঘুম রাতের পিছনেও এইসব গল্পের ও চরিত্রের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ইতো নিজে কি শৈশবে এরকম কোনো নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন? আর শিল্প ও সাহিত্যের এই বিশেষ ক্ষেত্রে কাজ করার পিছনে তার অনুপ্রেরণা কী ছিল? কীভাবে তিনি এই জগতে এলেন? আর তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাই বা কী? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
বয়স যখন ৪ অথবা ৫ বছর ছিল, তখন বোনেদের পড়তে দেখে জুঞ্জি ইতো নিজেও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘কাজুও উমেজি’ এবং ‘সিনিচি কোগা’ র লেখা ভৌতিক ম্যাঙ্গা গল্প পড়তেন। ঐ গল্পগুলো পড়ে তিনি কিন্তু তেমন একটা ভয় পেতেন না, উল্টো সেগুলো তার কাছে বেশ মজার মনে হত। বরং টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখানো ‘হন্টেড হাউজ’ (হানা বাড়ি) ও আত্মা সংক্রান্ত ভৌতিক অনুষ্ঠানগুলো দেখেই তিনি ভয় পেতেন। সেই ভয় এতটাই বেশি ছিল যে বাড়ির নিচে একটি সুড়ঙ্গের কোণায় অবস্থিত বাথরুমে একা যাওয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা; তাছাড়া ঐ বাথরুমে লম্বা লম্বা পা-ওয়ালা মাকড়সা ও পোকাও ছিল। ছেলেবেলার সেই ভয় থেকেই তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট শৈল্পিক প্রতিভার বিকাশ ঘটে এবং ভৌতিক ম্যাঙ্গা গল্পের জগতে তাকে একজন সফল শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ইতো ছেলেবেলা থেকে বরাবরই উমেজি’র লেখার ভক্ত ছিলেন। আর এই শিল্পীর মাধ্যমেই, অন্তত উমেজি’র সাথে সম্পর্কিত একটি উপায়েই, ভৌতিক ম্যাঙ্গার জগতে তার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে নতুন প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘গেক্কা হ্যালোউইন’ ভৌতিক ছোট গল্প পাঠানোর জন্য লেখকদের আহ্বান জানায় এবং পুরস্কার স্বরূপ সবচেয়ে ভাল গল্পকারকে ‘উমেজি অ্যাওয়ার্ড’ প্রদানের ঘোষণা করে। ছেলেবেলা থেকেই উমেজি’র লেখা পড়ে বেড়ে ওঠা ইতো যে এই আহ্বানে সাড়া দিবেন, তা বলাই বাহুল্য। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে একটি ছোট গল্প লিখে তিনি এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং পুরস্কারও জিতে নেন। সেই সাথে উক্ত ম্যাগাজিনের হয়ে ছোট গল্প লেখার জন্য তাকে স্থায়ী পদে নিযুক্তও করা হয়। এরপর থেকে পরবর্তী তের বছর পর্যন্ত তিনি এই চাকরিই করে যান। ‘টমি’ ছাড়াও ইতো’র সৃষ্ট অন্যান্য একক ছোটগল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সুঈচী, ডায়িং অ্যালোন, দ্য হ্যাঙ্গিং ব্যালুন, হেয়ার ইন দ্য অ্যাট্টিক, লং ড্রীম ইত্যাদি। ইতো’র পূর্ণদৈর্ঘ্য গল্পের ধারাবাহিক দু’টি হল ‘উজুমাকি’ ও ‘গায়ো’।
যথাক্রমে ৮০ ও ৯০ এর দশকে প্রকাশিত ‘টমি’ ও ‘সুঈচী’- ৩০ বছরের শিল্পীজীবনে ইতো’র সৃষ্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল দু’টি চরিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ৮০ এর দশক থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টমি’র গল্প পুরো তিনটি ভল্যুমে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টমি’র গল্পগুলো নিয়ে মোট আটটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। অন্যদিকে ‘সুঈচী’স জার্নাল অফ ডিলাইটস্’ এর মাধ্যমে উক্ত নামের চরিত্রটিকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিভিন্ন গল্পকে ধারাবাহিক আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই দুইটি চরিত্র ও সংশ্লিষ্ট গল্পের মাধ্যমে শৈশবকাল থেকে নারীর সৌন্দর্য্য ও এই ভৌতিক গল্পের প্রতি ইতো’র তীব্র আকর্ষণেরই পরিচয় পাওয়া যায়।
আরো পড়ুন: মীনা: সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তনকারী এক যুগান্তকারী চরিত্র
পূর্ণদৈর্ঘ্য ধারাবাহিক গল্প ‘উজুমাকি’ ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়। এই ধারাবাহিকের প্রতিটি গল্পই একটার সাথে আরেকটা সম্পর্কিত এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে। একটি সাপ্তাহিক ম্যাঙ্গা ম্যাগাজিনে এই ধারাবাহিকটি প্রকাশিত হয়। আর ২০০১ সালে ‘ভিজ মিডিয়া’ এই ধারাবাহিকটি পাশ্চাত্যের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করে। সমালোচকদের প্রশংসা অর্জনকারী এই ধারাবাহিকটি ২০০৩ সালে ‘আইজনার অ্যাওয়ার্ড’ এর জন্য মনোয়নপ্রাপ্ত হয়। উজুমাকি’র গল্প নিয়ে ২০০১ সালে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়। আর ‘ওয়াণ্ডারসোয়ান’ এর জন্য ‘বান্দাই’, ‘উজুমাকি: নোরোই সিমুলেশন’ নামে একটি গেম তৈরি করে; তবে এই গেমটি এর নির্ধারিত ভোক্তাদের কাছে আশানুরূপ গ্রহণযোগ্যতা লাভে ব্যর্থ হয়। ২০০১ সালে ইতো’র সৃষ্ট দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য গল্পের ধারাবাহিক ‘গায়ো’ প্রকাশিত হয়। এটিও সমালোচকদের নিকট প্রশংসিত হয় এবং যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও লাভ করে, কিন্তু পাঠকদের নিকট এর গ্রহণযোগ্যতা আগের গল্পগুলির মত ততটা ছিলনা। এরপর থেকে বিগত কয়েক বছর যাবৎ ইতো ছোট গল্প লেখার কাজেই পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছেন। ইতো’র গল্প নিয়ে নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য হ্যাঙ্গিং ব্যালুন’ (২০০১) এবং ‘গায়ো: দ্য ফিশ অ্যাটাক’ (২০১২)।
২০১৮ সালের গোড়ার দিকে ইতো’র সামগ্রিক কাজের সমন্বয়ে ‘জুঞ্জি ইতো: কালেকশন’ নামে একটি অ্যানিমে সিরিজ প্রকাশ করা হয়। এসকল গল্প ও চরিত্রের স্রষ্টা ইতো নিজে যদিও মনে করেন যে এতে উপস্থাপিত বেশ কয়েকটি গল্পের পরিবেশনা তার মূল কাজের চেয়েও ভাল হয়েছে, তার ভক্তদের মাঝে কিন্তু এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এই অ্যানিমেটেড ধারাবাহিকটিকই ইতো’র এযাবৎকালের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী কাজ বলে বিবেচিত। এই ধারাবাহিকটিও একাধিক ভাষায় রূপান্তর করা হয়েছে। আর অনেক সমালোচকের মতে, এই কারণেই এই ধারাবাহিকটি ভক্তদের কাছে আশানুরূপ গ্রহণযোগ্যতা লাভে ব্যর্থ হয়েছে; কারণ, পাশ্চাত্যের পাঠক ও ভক্তরা এই ধারাবাহিকটির মাধ্যমেই ইতো’র কাজের সাথে প্রথমবারের মত পরিচিত হয়। তারা এই ধরনের ভৌতিক গল্পের সাথে পরিচিত না থাকায় এর অর্থ যথার্থভাবে অনুধাবন করতে পারেনি।
ভৌতিক ম্যাঙ্গা গল্পের জগতে ইতো’র ৩০তম বছরটিকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দ্যেশ্যে ‘ইগায়ো সেকাই’ (অতিপ্রাকৃতিক বিশ্ব) নামে একটি আর্টবুক বা ছবির বই প্রকাশ করা হয়। এটিও বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ইতো’র সৃষ্ট সকল গল্পকেই এই বইয়ে উপস্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু ৩০ বছরের সকল কাজ একটি মাত্র বইয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলে পরবর্তীতে শুধুমাত্র ইতো’র মৌলিক গল্পগুলোকেই এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বইটির কভারে ব্যবহৃত ইলাস্ট্রেশনের মাধ্যমে তৈরি চিত্রকর্মটি ইতো নিজেই সৃষ্টি করেছেন।
ছোট গল্প, পূর্ণদৈর্ঘ্য গল্প, গেম, চলচ্চিত্র, অ্যানিমেটেড ধারাবাহিক, আর্টবুক- সবকিছু মিলে ভৌতিক ম্যাঙ্গার জগতে জুঞ্জি ইতো’র ৩০ বছরের কর্মজীবনকে অনায়াসেই বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সফল বলা চলে। শৈশবের ভাললাগার বিষয় ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কর্মজীবনে সফলতা লাভের বিষয়টি রীতিমত স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতই একটি ঘটনা এবং এই স্বপ্ন খুব অল্প সংখ্যক মানুষের বেলায়ই সত্যি হয়। জুঞ্জি ইতো সেই অল্প সংখ্যক মানুষদেরই একজন। ভবিষ্যতের জন্য ইতো’র এখনো তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই, তিনি বেশি দূরের ভবিষ্যৎ বা দীর্ঘমেয়াদী কোনো কাজ নিয়ে পরিকল্পনা করেন না। বর্তমানে তাই তিনি আরও ছোট গল্প তৈরিতেই বেশি আগ্রহী। সেই সাথে আরও একটি কাজ তিনি চালিয়ে যেতে চান আর তা হল ইলাস্ট্রেশনের মাধ্যমে চিত্রকর্ম তৈরি, যা কিছুটা ভিন্ন ধরনের হলেও এক প্রজাতির শিল্পকর্মই বটে। এই নতুন ধরনের শিল্পকর্মের মাধ্যমেও তিনি তার ভক্তদের মন জয় করতে পারেন কিনা তা জানতে পারা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র।
সোহেলী তাহমিনা, বিডি.টুনসম্যাগ.কম
ইংরেজিতে পড়ুন: Junji Ito: Enchanting Horror Manga Creator for 30 years
আরো পড়ুন: মীনা: সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তনকারী এক যুগান্তকারী চরিত্র
হরর ম্যাঙ্গা বা ভৌতিক ম্যাঙ্গা গল্পের জগতে, বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পীদের মধ্যে জুঞ্জি ইতো শীর্ষস্থানীয়। বিগত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এসকল গল্প ও চরিত্র তৈরি করে আসছেন যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাঠকদের বিনোদনের খোরাক যুগিয়েছে; আর, বলাই বাহুল্য যে সেই সাথে পাঠকদের নির্ঘুম রাতের পিছনেও এইসব গল্পের ও চরিত্রের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ইতো নিজে কি শৈশবে এরকম কোনো নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন? আর শিল্প ও সাহিত্যের এই বিশেষ ক্ষেত্রে কাজ করার পিছনে তার অনুপ্রেরণা কী ছিল? কীভাবে তিনি এই জগতে এলেন? আর তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাই বা কী? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
বয়স যখন ৪ অথবা ৫ বছর ছিল, তখন বোনেদের পড়তে দেখে জুঞ্জি ইতো নিজেও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘কাজুও উমেজি’ এবং ‘সিনিচি কোগা’ র লেখা ভৌতিক ম্যাঙ্গা গল্প পড়তেন। ঐ গল্পগুলো পড়ে তিনি কিন্তু তেমন একটা ভয় পেতেন না, উল্টো সেগুলো তার কাছে বেশ মজার মনে হত। বরং টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখানো ‘হন্টেড হাউজ’ (হানা বাড়ি) ও আত্মা সংক্রান্ত ভৌতিক অনুষ্ঠানগুলো দেখেই তিনি ভয় পেতেন। সেই ভয় এতটাই বেশি ছিল যে বাড়ির নিচে একটি সুড়ঙ্গের কোণায় অবস্থিত বাথরুমে একা যাওয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা; তাছাড়া ঐ বাথরুমে লম্বা লম্বা পা-ওয়ালা মাকড়সা ও পোকাও ছিল। ছেলেবেলার সেই ভয় থেকেই তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট শৈল্পিক প্রতিভার বিকাশ ঘটে এবং ভৌতিক ম্যাঙ্গা গল্পের জগতে তাকে একজন সফল শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ইতো ছেলেবেলা থেকে বরাবরই উমেজি’র লেখার ভক্ত ছিলেন। আর এই শিল্পীর মাধ্যমেই, অন্তত উমেজি’র সাথে সম্পর্কিত একটি উপায়েই, ভৌতিক ম্যাঙ্গার জগতে তার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে নতুন প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘গেক্কা হ্যালোউইন’ ভৌতিক ছোট গল্প পাঠানোর জন্য লেখকদের আহ্বান জানায় এবং পুরস্কার স্বরূপ সবচেয়ে ভাল গল্পকারকে ‘উমেজি অ্যাওয়ার্ড’ প্রদানের ঘোষণা করে। ছেলেবেলা থেকেই উমেজি’র লেখা পড়ে বেড়ে ওঠা ইতো যে এই আহ্বানে সাড়া দিবেন, তা বলাই বাহুল্য। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে একটি ছোট গল্প লিখে তিনি এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং পুরস্কারও জিতে নেন। সেই সাথে উক্ত ম্যাগাজিনের হয়ে ছোট গল্প লেখার জন্য তাকে স্থায়ী পদে নিযুক্তও করা হয়। এরপর থেকে পরবর্তী তের বছর পর্যন্ত তিনি এই চাকরিই করে যান। ‘টমি’ ছাড়াও ইতো’র সৃষ্ট অন্যান্য একক ছোটগল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সুঈচী, ডায়িং অ্যালোন, দ্য হ্যাঙ্গিং ব্যালুন, হেয়ার ইন দ্য অ্যাট্টিক, লং ড্রীম ইত্যাদি। ইতো’র পূর্ণদৈর্ঘ্য গল্পের ধারাবাহিক দু’টি হল ‘উজুমাকি’ ও ‘গায়ো’।
যথাক্রমে ৮০ ও ৯০ এর দশকে প্রকাশিত ‘টমি’ ও ‘সুঈচী’- ৩০ বছরের শিল্পীজীবনে ইতো’র সৃষ্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল দু’টি চরিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ৮০ এর দশক থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টমি’র গল্প পুরো তিনটি ভল্যুমে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টমি’র গল্পগুলো নিয়ে মোট আটটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। অন্যদিকে ‘সুঈচী’স জার্নাল অফ ডিলাইটস্’ এর মাধ্যমে উক্ত নামের চরিত্রটিকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিভিন্ন গল্পকে ধারাবাহিক আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই দুইটি চরিত্র ও সংশ্লিষ্ট গল্পের মাধ্যমে শৈশবকাল থেকে নারীর সৌন্দর্য্য ও এই ভৌতিক গল্পের প্রতি ইতো’র তীব্র আকর্ষণেরই পরিচয় পাওয়া যায়।
আরো পড়ুন: মীনা: সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তনকারী এক যুগান্তকারী চরিত্র
পূর্ণদৈর্ঘ্য ধারাবাহিক গল্প ‘উজুমাকি’ ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়। এই ধারাবাহিকের প্রতিটি গল্পই একটার সাথে আরেকটা সম্পর্কিত এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে। একটি সাপ্তাহিক ম্যাঙ্গা ম্যাগাজিনে এই ধারাবাহিকটি প্রকাশিত হয়। আর ২০০১ সালে ‘ভিজ মিডিয়া’ এই ধারাবাহিকটি পাশ্চাত্যের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করে। সমালোচকদের প্রশংসা অর্জনকারী এই ধারাবাহিকটি ২০০৩ সালে ‘আইজনার অ্যাওয়ার্ড’ এর জন্য মনোয়নপ্রাপ্ত হয়। উজুমাকি’র গল্প নিয়ে ২০০১ সালে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়। আর ‘ওয়াণ্ডারসোয়ান’ এর জন্য ‘বান্দাই’, ‘উজুমাকি: নোরোই সিমুলেশন’ নামে একটি গেম তৈরি করে; তবে এই গেমটি এর নির্ধারিত ভোক্তাদের কাছে আশানুরূপ গ্রহণযোগ্যতা লাভে ব্যর্থ হয়। ২০০১ সালে ইতো’র সৃষ্ট দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য গল্পের ধারাবাহিক ‘গায়ো’ প্রকাশিত হয়। এটিও সমালোচকদের নিকট প্রশংসিত হয় এবং যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও লাভ করে, কিন্তু পাঠকদের নিকট এর গ্রহণযোগ্যতা আগের গল্পগুলির মত ততটা ছিলনা। এরপর থেকে বিগত কয়েক বছর যাবৎ ইতো ছোট গল্প লেখার কাজেই পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছেন। ইতো’র গল্প নিয়ে নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য হ্যাঙ্গিং ব্যালুন’ (২০০১) এবং ‘গায়ো: দ্য ফিশ অ্যাটাক’ (২০১২)।
২০১৮ সালের গোড়ার দিকে ইতো’র সামগ্রিক কাজের সমন্বয়ে ‘জুঞ্জি ইতো: কালেকশন’ নামে একটি অ্যানিমে সিরিজ প্রকাশ করা হয়। এসকল গল্প ও চরিত্রের স্রষ্টা ইতো নিজে যদিও মনে করেন যে এতে উপস্থাপিত বেশ কয়েকটি গল্পের পরিবেশনা তার মূল কাজের চেয়েও ভাল হয়েছে, তার ভক্তদের মাঝে কিন্তু এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এই অ্যানিমেটেড ধারাবাহিকটিকই ইতো’র এযাবৎকালের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী কাজ বলে বিবেচিত। এই ধারাবাহিকটিও একাধিক ভাষায় রূপান্তর করা হয়েছে। আর অনেক সমালোচকের মতে, এই কারণেই এই ধারাবাহিকটি ভক্তদের কাছে আশানুরূপ গ্রহণযোগ্যতা লাভে ব্যর্থ হয়েছে; কারণ, পাশ্চাত্যের পাঠক ও ভক্তরা এই ধারাবাহিকটির মাধ্যমেই ইতো’র কাজের সাথে প্রথমবারের মত পরিচিত হয়। তারা এই ধরনের ভৌতিক গল্পের সাথে পরিচিত না থাকায় এর অর্থ যথার্থভাবে অনুধাবন করতে পারেনি।
ভৌতিক ম্যাঙ্গা গল্পের জগতে ইতো’র ৩০তম বছরটিকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দ্যেশ্যে ‘ইগায়ো সেকাই’ (অতিপ্রাকৃতিক বিশ্ব) নামে একটি আর্টবুক বা ছবির বই প্রকাশ করা হয়। এটিও বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ইতো’র সৃষ্ট সকল গল্পকেই এই বইয়ে উপস্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু ৩০ বছরের সকল কাজ একটি মাত্র বইয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলে পরবর্তীতে শুধুমাত্র ইতো’র মৌলিক গল্পগুলোকেই এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বইটির কভারে ব্যবহৃত ইলাস্ট্রেশনের মাধ্যমে তৈরি চিত্রকর্মটি ইতো নিজেই সৃষ্টি করেছেন।
ছোট গল্প, পূর্ণদৈর্ঘ্য গল্প, গেম, চলচ্চিত্র, অ্যানিমেটেড ধারাবাহিক, আর্টবুক- সবকিছু মিলে ভৌতিক ম্যাঙ্গার জগতে জুঞ্জি ইতো’র ৩০ বছরের কর্মজীবনকে অনায়াসেই বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সফল বলা চলে। শৈশবের ভাললাগার বিষয় ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কর্মজীবনে সফলতা লাভের বিষয়টি রীতিমত স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতই একটি ঘটনা এবং এই স্বপ্ন খুব অল্প সংখ্যক মানুষের বেলায়ই সত্যি হয়। জুঞ্জি ইতো সেই অল্প সংখ্যক মানুষদেরই একজন। ভবিষ্যতের জন্য ইতো’র এখনো তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই, তিনি বেশি দূরের ভবিষ্যৎ বা দীর্ঘমেয়াদী কোনো কাজ নিয়ে পরিকল্পনা করেন না। বর্তমানে তাই তিনি আরও ছোট গল্প তৈরিতেই বেশি আগ্রহী। সেই সাথে আরও একটি কাজ তিনি চালিয়ে যেতে চান আর তা হল ইলাস্ট্রেশনের মাধ্যমে চিত্রকর্ম তৈরি, যা কিছুটা ভিন্ন ধরনের হলেও এক প্রজাতির শিল্পকর্মই বটে। এই নতুন ধরনের শিল্পকর্মের মাধ্যমেও তিনি তার ভক্তদের মন জয় করতে পারেন কিনা তা জানতে পারা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র।
সোহেলী তাহমিনা, বিডি.টুনসম্যাগ.কম
ইংরেজিতে পড়ুন: Junji Ito: Enchanting Horror Manga Creator for 30 years