ডিজনী প্রিন্সেস কেন আধুনিক নারীবাদের ক্ষেত্রে পিছিয়ে?
প্রতিটি মানুষের জীবনে একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব বা অনুপ্রেরণার কথা অসংখ্যবার বলা ও শোনা হয়ে থাকে। ‘বড় হয়ে কী হতে চাও?’ এই প্রশ্নটি শোনেনি,...
![](https://img2.blogblog.com/img/icon18_edit_allbkg.gif)
https://bd.toonsmag.com/2019/07/blog-post_31.html
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEisbavpFFFSsFCY_CYedNODE4gRMkXrCufVKAFcPLn1lPH43DLvbGlhVrNMloygsCRh5xiMDJh-OHSxa3YFpty8z5irUaQZNBGcG8bIp6vKSfJpBGvXtjI-PjbmSaIUPEtuVkV_-EedM_A/s1600/Image+result+for+disney+princess.jpg)
প্রতিটি মানুষের জীবনে একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব বা অনুপ্রেরণার কথা অসংখ্যবার বলা ও শোনা হয়ে থাকে। ‘বড় হয়ে কী হতে চাও?’ এই প্রশ্নটি শোনেনি, এমন শিশু পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য যে কোনো বাচ্চা মেয়েই সবার আগে ডিজনী’র সুদীর্ঘ ও অত্যন্ত আকর্ষণীয় প্রিন্সেসদের তালিকা থেকে কোনো একজনের নামই বলবে, তা বলাই বাহুল্য। কারণ এই তালিকার অন্তর্ভুক্তরা বিভিন্নভাবে ঐ বাচ্চা মেয়েদের জীবনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আর তাই এটাই তাদের জন্য ঐ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়। ডিজনী রাজকন্যাদের এই রাজ্যে একের পর এক অনিন্দ্যসুন্দরী এবং অসাধারণ দয়ালু ও পরোপকারী প্রধান নারী চরিত্রদের উপস্থাপন করা হয়েছে, যাদের জীবনে কোনো উচ্চাভিলাষ বা পেশাগত লক্ষ্য বা অ্যাম্বিশন নেই বললেই চলে। এই শেষের বিষয়টি অর্থাৎ ‘অ্যাম্বিশন নেই’- এই বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কও রয়েছে।
ডিজনীর অনেক গল্পেই রাজকন্যাদের জীবনযুদ্ধের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো রাজকন্যাকে তো একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে যু্দ্ধ করতেও দেখানো হয়েছে। কিন্তু ‘সকলকে খুশি করা’র নিরন্তর প্রয়াসের আড়ালে সেসব সাহসিকতা বরাবরই চাপা পরে যায়। এখন পর্যন্ত ডিজনীর জগতে এমন কোনো প্রধান নারী চরিত্রকে দেখা গেছে কি যে অন্যদের সাথে রুঢ়ভাবে বা স্পষ্টাস্পষ্টি কথা বলে? অন্তত আমার তো মনে পরে না। ১৯৩৭ সালে ‘স্নো হোয়াইট’ এর আবির্ভাবের মাধ্যমে এই রাজকন্যা ও তাদের রাজত্বের গল্পের শুরু হয়। সেসময়ে স্নো হোয়াইটকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই এই সাম্রাজ্যে আরও দুইজন রাজকন্যাকে উপস্থাপন করা হয়- সিণ্ডারেলা ও অরোরা (দ্য স্লিপিং বিউটি)। ১৯৫৯ সালে যখন অরোরা তার অভিশপ্ত নিদ্রা থেকে জেগে উঠল, ঠিক সেসময়েই ডিজনী নিজেই যেন ঘুমাতে গেল। এরপরে বেশ দীর্ঘ সময় যাবৎ নতুন কোনো রাজকন্যার আবির্ভাব ঘটেনি। তারপরে ১৯৮৯ সালে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হল ‘অ্যারিয়েল’ (দ্য লিটল্ মাার্মেইড)। এ পর্যন্ত সকল রাজকন্যার গল্পই মোটামুটি একই রকম- একজন রাজকন্যা যাকে ‘ভাল মেয়ে’ বলে দর্শকরা ভালবাসে; আর যে দয়ালু, নি:স্বার্থ, রূপবতী এবং সব সময়ই ‘সকলের ভাল’ করতে উদ্যত। সকলের প্রিয় এই রাজকন্যাদের দেখা যায় স্বপ্নের রাজপুত্রের খোঁজে বিভিন্ন ধরনের বাধা বিপত্তি পেরিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নিজের খুশি, এমনকি ব্যক্তিত্বের অনেক কিছুই ত্যাগ করতে। এই রাজকন্যারা একদিকে যেমন সকলের খুশির জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি নিজের খুশির কথা সব সময়ই ভুলে থাকছে।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiBQ4buVn8tmOdrhtB1_6oLmlyG-2cwKHfKrSSkUw7D30I1zq0O-gTZBsafGm3a4P2L9ypeR5xRGsWfRarTVOvaX4nZlR5DK-zzzDAw7cm6q2ZOW867m029zHsD8GIxAzql-qWMZPJTxlQ/s640/joctud.mrbssoutherncupboard.com.jpg)
ডিজনীর এই রূপকথার রাজ্যে হঠাতই একটি লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন আসে যখন ১৯৯২ সালে ‘আলাদীন’ এর রাজকন্যা হিসেবে ‘জেসমিন’ কে উপস্থাপন করা হয়। জেসমিন অন্যান্য শ্বেত সুন্দরীদের মত বা স্বর্গের অপ্সরাদের মত নয়। তার সাথে বাস্তবের মেয়েদের বেশ খানিকটা সাদৃশ্য রয়েছে। আর সে কোনো স্বপ্নের রাজপুত্রকে বিয়ে করে সংসারী হওয়ার স্বপ্ন দেখেনি, বরং সে তার স্বপ্নকে সত্যি করার প্রয়াসে নিয়োজিত। ধীরে ধীরে ডিজনীর রাজকন্যাদের এই জগতে একে একে আগমন ঘটে পোকাহোন্টাস, মুল্যান, মেরিডা, এলসা’র মত রাজকন্যাদের যারা সকলেই তাদের পূর্ববর্তী রাজকন্যাদের চেয়ে বেশ খানিকটা ভিন্ন। তারা কোনো রাজপুত্রকে ভালবেসে তার চোখে আদর্শ স্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেনি। তাদের নিজস্ব জীবন রয়েছে, আর রয়েছে নিজস্ব জীবনযুদ্ধ যেখানে তাদের প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো সমস্যার সম্মুক্ষীণ হতে হয়। তারা নিজেরাই নিজেদের যাত্রাপথ ও লক্ষ্য তৈরি করে নেয়। তারা ডিজনীর চিরাচরিত রাজকন্যাদের মত নয়। কিন্তু এরপরেও তাদের মাঝে পুরনোদের সাথে বেশ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে যা সংশোধন হওয়া আবশ্যক- বিশেষত, যদি এই রাজকন্যাদের জন্য একবিংশ শতাব্দীর ছোট বাচ্চা মেয়েদের কাছে আদর্শ হয়ে থাকাটা আদৌ জরুরী হয়ে থাকে।
শুরুতেই চলুন কিছু চমকপ্রদ তথ্য সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। কয়েক বছর আগে স্পেনের গ্রেনাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল ’মন্সটার হাই’ ও ‘শিন চ্যান’ সহ মোট ১৬৩ টি কার্টুন সিরিজের ৬২১ টি চরিত্র নিয়ে গবেষণা চালায়। এসকল অ্যানিমেটেড সিরিজের নারী চরিত্রগুলি খুব স্বাভাবিকভাবেই চিরাচরিত ভূমিকা যেমন মা, গার্লফ্রেণ্ড বা উক্ত সিরিজের হিরো বা ভিলেনের সহচরী’র ভূমিকাতেই উপস্থাপিত হয়েছে। ঈর্ষা, বাহ্যিক রূপ নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি, সব সময় অন্যকে খুশি করার চেষ্টা, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো থেকে শুরু করে বৈশ্বয়িক লোভ-লালসার মত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও এসকল নারী চরিত্রের মাঝে উপস্থাপন করা হয়। অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায় যে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ডিজনী’র নির্মিত চলচ্চিত্র সমূহে পুরুষ চরিত্রগুলোর কথোপকথনের সময় ছিল নারী চরিত্রগুলোর তুলনায় তিন গুণ। মার্কিন ভাষাবিদেরা এই পার্থক্যকে আরও সুস্পষ্টভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন। তাদের গবেষণার মতে পুরুষদের জন্য কথোপকথনের সময়ের পরিমাণ ‘দ্য লিটল্ মার্মেড’ এ ছিল ৬৮%, ‘বিউটি এণ্ড দ্য বিস্ট’ এ ছিল ৭১%, ‘আলাদীন’ এ ৯০% এবং ‘পোকাহোন্টাস’ এ ৭৬%। এই বিতর্কিত বিষয়টিকে আরও বাড়িয়ে দেখানো হয় যে অ্যারিয়েল, তার ভালবাসার মানুষটিকে কাছে পাওয়ার জন্য সারাজীবন বোবা হয়ে থাকার তথা নিজের বাকশক্তি বিসর্জন দেওয়ার মত ত্যাগ স্বীকার করে। আর পোকাহোন্টাস এর মাধ্যমে দেখানো হয় যে শুধু বাস্তবেই নয়, এমনকি কার্টুনের জগতেও ‘একজন নারী তার জীবনে সবকিছুই পেতে পারেনা’। তাকে পেশাগত সাফল্য ও প্রেম এর মধ্যে যে কোনো একটি বেছে নিতে হয়।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiFBFmRD-HwOTcEFFil8ECot9OB8uECj5dP4tMGNs4EnX20cXQs6JsmU29jh-CUWTvjNS4o99geWZQVOucQh9NmYmep-vTiGvdl8O6Dmw-0VuJXnXbc6S0RXCL_yArBfdNVlSzN0nDz6fQ/s640/aldi.co.uk.jpg)
কিন্তু চলচ্চিত্রে দেখানো এই সকল বিষয় বাস্তব জীবনে মেয়ে শিশুদের মনের ওপর অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে, বিশেষ করে যখন তারা নিজেদের এসকল রাজকন্যাদের সাথে মেলানোর চেষ্টা করে, বা তাদের মত হতে চায়। তাদের মনে এই বিষয়টি দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায় যে জীবনের চলার পথে মেয়েদের ভূমিকা সব সময়ই পরোক্ষ হয়ে থাকে। নিজস্ব বাহ্যিক সৌন্দর্যের মাধ্যমে তারা জীবনের বাহ্যিক সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্যই নিয়োজিত এবং নিজেদের স্বপ্ন পূরণে প্রয়োজনীয় কিন্তু সৌন্দর্যের হানি ঘটায় এমন কোনো কাজ (নৈতিক ও বৈধ উপায়ে) করা তাদের শোভা দেয় না বলেই তাদের শেখানো হয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকেই তাদের এই শিক্ষাই দেওয়া হয় যে সমাজ, দেশ ও দশের কল্যাণের এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ‘সুপারপাওয়ার’ শুধুমাত্র সুপারহিরো তথা পুরুষদেরই দেওয়া হয়ে থাকে; অন্যদিকে, মেয়েদের শুক্তি-সামর্থ্য শুধুমাত্র পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের জন্যই উপযুক্ত, সামগ্রিক মানব কল্যাণের জন্য নয়। ডিজনী রাজকন্যা চীনা যোদ্ধা মুল্যানকে তার সহকারি ও দেশবাসি অনুসরণ ও শ্রদ্ধা করত কারণ সে তার চুল কেটে ছোট করে রাখত এবং পুরুষদের পোশাক পরে থাকত। অর্থাৎ যোগ্যতা থাকলেও একজন পুরুষের সমমর্যাদা একজন নারী কখনই পেতে পারেনা। একজন যোগ্য শাসক হওয়ার পরেও ‘ফ্রোজেন’ খ্যাত রাজকন্যা এলসা নিজের রাগ ও অন্যান্য অপ্রিয় অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে যায়। এর থেকে এই দেখানো হয় যে, মেয়েদের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সংকল্পবদ্ধতা বা আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পুরুষেদের চেয়ে কম।
শিশুদের শেখানো হয় যে গোলাপী বা অন্যান্য হালকা ও নরম, ম্লান ধরনের রঙগুলোই মেয়েদের পছ্ন্দ হওয়া উচিৎ, কারণ মেয়েরা শুধু এই ধরনের নরম, সহনশীল অনুভূতিকেই প্রকাশের অধিকার রাখে; আর কঠিন, দৃঢ় অনুভূতিগুলো প্রকাশের অধিকার শুধুমাত্র পুরুষদের রয়েছে। তাদের শেখানো হয় যে মেয়েরা খেলবে সুন্দর সুন্দর রাজকন্যার আদলে তৈরি পুতুল দিয়ে, অন্যদিকে ছেলেরা খেলবে গাড়ী, বা বাড়ি তৈরির বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে। আর এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে সে ব্যাপারটিকে কখনই সমাজের চোখে স্বাভাবিকভাবে দেখা হয়না। ২০০৬ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস এ প্রকাশিত ‘হোয়াটস্ রঙ উইথ সিণ্ডারেলা?’ শীর্ষক আর্টিকল এবং ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘সিণ্ডারেলা এট মাই ডটার’ নামক বই এর মাধ্যমে লেখক পেগি ওরেনস্টিন এই সামাজিক রীতিনীতিগুলোকে, ভদ্রভাষায় বলতে গেলে, ‘অশোভন’ হিসেবে স্পষ্টাকারে দেখিয়েছেন। তার প্রকাশনার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে কীভাবে একটি সাধারণ কলম বা একটি ব্যাণ্ড-এইড থেকে শুরু করে একটি বাচ্চা মেয়ের জীবনের প্রতিটি অংশ এই ডিজনী রাজকন্যাদের জগৎ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। প্রিন্সেস কেক, গোলাপী রঙের বেলুন, এমনকি ডেন্টিস্টের কার্যালয়ে একটি প্রিন্সেস চেয়ার দ্বারা কীভাবে সমাজ তার মেয়ের ওপর এসকল চিরাচরিত রীতিনীতি আরোপের চেষ্টা করে যায়- তাও তিনি তার লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiuDBh8pvIQdPNV_Eo_4S5SIy3whBY3mt9wPoFJzGw9kiooS47gf6tYUqqxNbqe4YtzaH0D32GnIS0AXEgOseKnfPnPQ3ZrkFcereA6L0OCfLRqQj1yT0cqD4ThfulwQiXio8SKQ6bMDYM/s640/syfy.com.jpg)
ওরেনস্টিনের বই পড়ে প্রভাবিত হয়ে, শীর্ষস্থানীয় লেখক ও বার্মিংহ্যাম ইয়ং ইউনিভার্সিটি এর ‘ফ্যামিলি লাইফ’ বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সারাহ কয়ন ও তার গবেষক দল মিলে ১৯৮ টি প্রি-স্কুল ও কিণ্ডারগার্টেনের শিশুদের নিয়ে একটি গবেষণা চালান। তাদের গবেষণার মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল প্রিন্সেস-প্রভাবিত বিভিন্ন ধরনের প্রচার কাজের কারণে শিশুদের ওপর কী ধরনের প্রভাব পরতে পারে সে সম্পর্কে কিছু সুনির্দিষ্ট সামাজিক ডাটা বা উপাত্ত সংগ্রহ করা। তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত মূল তথ্যগুলো ছিল এরকম:
১. মেয়েরা যত বেশি ‘প্রিন্সেস-সংস্কৃতি’র সাথে জড়িত হয়, ততটাই তারা তথাকথিত মেয়েলী আচরণ করে।
২. ঐ গবেষণা চলার সময়ে নিজেদের শারীরিক গড়ন ও বাহ্যিক রূপ নিয়ে যে মেয়েদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল, এক বছর পরে তারা ‘প্রিন্সেস-সংস্কৃতি’র সাথে অন্যদের তুলনায় বেশি মাত্রায় জড়িত হয়ে পরে এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করতে শুরু করে।
৩. এই প্রিন্সেস-সংস্কৃতি যে মেয়েদের একজন যোগ্য নেতৃ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য কোনো বিশেষ ধরনের সহায়তা করছে তার সপক্ষে কোনো শক্ত যুক্তি পাওয়া যায়না; অর্থাৎ প্রিন্সেস-সংস্কৃতি মেয়েদের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য মোটেও ইতিবাচক আদর্শ হিসেবে বিবেচ্য হতে পারেনা।
যদিও এই বিষয়ে অভিভাবকদের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি; তবে কয়ন বিশ্বাস করেন যে মেয়ে শিশুদের এই ধরনের মনোভাব গড়ে ওঠার পিছনে অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা খুব সাধারণ। কারণ কোনো বাবা-মা যদি সন্তানের সামনে কোনো রূপকথার রাজকন্যার বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রশংসা করে থাকে, তাহলে সেই সন্তান তার বাবা-মায়ের চোখে সেরা হয়ে উঠার জন্য যে কোনো কাজ করতে প্রস্তুত থাকবে। এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি শুধুমাত্র কার্টুনের জগতেই সীমাবদ্ধ নেই। শিল্প-সাহিত্যের যে কোনো সৃষ্টিতেই একজন নারীকে মাতৃসুলভ, নমনীয়, দয়ালু, নি:স্বার্থ ও অন্যকে খুশি করার চেষ্টায় নিয়োজিত ব্যক্তিত্ব হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে। একজন নারীকে সব সময় অন্যের চোখে ‘ভাল’ হতে হবে এবং একজন আদর্শ পুরুষকে বিয়ে করে সংসারী হতে হবে- এটাই সমাজের নিয়ম। নিজের জীবনের সাথে জড়িত সকল কিছুর বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার শিক্ষাই দেওয়া হয়ে থাকে মেয়েদের।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEifGUXx3sLl-gnAHcnD79YztyGi3oq1nKOWvfxHi6cj8NDAiz1s0VmPsA6sYfgCD3WgoDXBjob0GHrsY0YRwzmai3W5VPqCohEC7UQ5PHdDdStL-h-5GYoeuEX1OFmzYVrTsIKgyqUSEyo/s1600/matalan.co.uk.jpg)
আর এই শিক্ষাই আমাদের বাস্তব জীবনেও প্রকাশিত হয়ে থাকে। যখন কোনো নারীকে তরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী, কূটনৈতিক বিষয় বুঝতে অক্ষম এবং শিশুসুলভ বোকামি করতে দেখানো হয় তখন আমরা বেশ আনন্দ পাই এবং বিষয়টিকে নিয়ে মজা করি ও হাসাহাসি করে থাকি। সাধারণ মেয়েলী কাজের সংজ্ঞার আওতায় পরে এমন যে কোনো পেশা যেমন শিক্ষকতা, চিকিৎসা, ফ্যাশন ডিজাইন সহ অন্যান্য নরম ব্যক্তিত্ব ও সহনশীল পেশাতেই একজন নারীকে বেশি গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই সকল চিরাচরিত পেশার বাইরে গিয়ে যখনি কোনো নারী কোনো পর্বতের চূড়ায় ওঠে, বা মোটরসাইকেল চালিয়ে কোনো উপত্তকা পাড়ি দেয় বা কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ঘটায়- তখন তার এই অর্জনের কারণে সে গোটা পৃথিবী জুড়ে খ্যাতি লাভ করে, যার ফলে ‘একজন মেয়ে হিসেবে তার এরকম কোনো কাজ করার কথা না’ এই ধারণাটিকে আরও বেশি প্রশ্রয় দেওয়া হয়। যখন কোনো নারী কোনো রাজনৈতিক নেতা’র ভূমিকা পালন করে তখন ধরেই নেওয়া হয় যে কোনো সাড়া জাগানো রাজনৈতিক পরিকল্পনা মূলত তার নিজের মস্তিষ্কের ফলপ্রসূ নয়, বরং দলে থাকা পুরুষ উপদেষ্টারই কৃতিত্ব।
বিশ্বায়ন ও ডিজিটাইজেশন এর এই অত্যাধুনিক যুগে এসেও কেন এই ধরনের ধারণা পোষণ করা হচ্ছে? আর যখন এরকম চিরাচরিত সামাজিক রীতিনীতিকে আমাদের জীবনাচারণের সাথে জড়িয়ে আলোচনা-সমালোচনা করা হয়, তখন আমরা মেয়েরাই বা কতবার সেই ঘটনার প্রতিবাদ করি? প্রতিবার যখন কোনো নারীকে তার পেশাগত অর্জনের জন্য পুরুষের চেয়ে বেশি প্রশংসা করা হয় তখনই তার উচিৎ ঐ ধরনের প্রশংসার বিরোধীতা করা এবং এই ধরনের প্রচারকাজে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা। দেরীতে এসেও কোনো লাইনের সামনের দিকে জায়গা পেয়ে যাওয়া, কোনো সুস্বাদু খাবারের শেষ টুকরোটি নিজের পাতে দিতে দেওয়া সহ জীবনের অর্থপূর্ণ যে কোনো পরিস্থিতি শুধু একজন নারী হওয়ার কারণে পাওয়া বিশেষ মর্যাদা বা সুবিধাকে বর্জন করাই একজন নারীর যথার্থ কর্তব্য। শুধুমাত্র নিজ মেধার গুণে যখন তার কাজ ও আচরণের জন্য তার প্রশংসা করা হয়, সেটিকেই তার গ্রহণ করা উচিৎ এবং নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করা উচিৎ।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEi48NMAabvt8RqJ4ZZZoxUG_6nAlw9h7zqSgMSD06gl7U8Ly7FBvX8A7Q1R-wyT-l9yTBrcxNS2iCwaOSIk5T6GxcKlbE0W31ZAMDHP8OpR9i57q9jf1i4ZXxkKrn83b3zuNejgt5xYhyY/s640/redtri.com.jpg)
একজন নারীই শুধু পারে সমাজের এসকল চিরায়ত নিয়ম ও রীতিনীতি ভেঙ্গে নিজের স্বকীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে এবং এক্ষেত্রে অ্যানিমেটেড তথা কার্টুন জগতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে।
ইংরেজিতে পড়ুন: Why Disney Princess Fails Modern Feminism?
ইংরেজিতে পড়ুন: Why Disney Princess Fails Modern Feminism?