প্রাণ কুমার শর্মা: ভারতীয় কমিক্সের যুগান্তকারী স্রষ্টা
https://bd.toonsmag.com/2019/08/blog-post.html
“প্রতিটি পরিবারেই একজন জ্ঞানী প্রৌঢ় থাকেন। তিনি তার বুদ্ধিমত্তা ও হাস্যরসের মাধ্যমেই তার সমস্যার সমাধান করে থাকেন। হাস্যরস আমার কার্টুনের মূল ভিত্তি।” - প্রাণ কুমার শর্মা, মরহুম ভারতীয় কমিক্স লেখকসুপারহিরোদের নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই এক বা একাধিক অতিপ্রাকৃত তথা বিশেষ শক্তির প্রসঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। গোটা পৃথিবীর প্রায় সকল কমিক্স বই-ই এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। আর অন্যদিকে ছিলেন- প্রাণ কুমার শর্মা- একজন ভারতীয় কমিক্স লেখক যিনি শারীরিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে দুষ্টু লোকেদের জব্দ করার চিরাচরিত রীতি সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে বদলে দিয়েছিলেন। নিজের তৈরি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র ‘চাচা চৌধুরী’- যা শুধু ভারতেই নয়, বরং গোটা বিশ্বের কমিক্সের জগতে সবচেয়ে যুগান্তকারী চরিত্রগুলির একটি- এর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে কীভাবে হাতাহাতির পরিবর্তে বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়েই বিভিন্ন জটিল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
প্রাথমিক জীবন
পাকিস্তানের লাহোরের নিকটবর্তী কাসুরে ১৯৩৮ সালে প্রাণ কুমার শর্মা জন্মগ্রহণ করেন। এরপরে তার পরিবার প্রথমে গোয়ালিয়রে ও ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পরে দিল্লীতে চলে আসে। ছোটবেলা থেকেই তিনি আঁকাআঁকি দেখেই বেড়ে ওঠেন, বিশেষত তার বড় ভাইয়ের আঁকাআঁকি দেখেই তিনি শিখেন এবং ভাইয়ের ব্যবহৃত রঙ-তুলি ব্যবহার করেই তিনি বাড়ির ঘরের দেওয়ালে ছবি আঁকতেন। মায়ের জন্য প্রাণের এই ধরনের আঁকিবুকি ছিল রীতিমত অসহনীয় দুরন্তপনা, কিন্তু এই দুরন্তপনার মাঝেই লুকিয়ে ছিল শিল্প ও সাহিত্যের জগতের এক অন্যতম প্রতিভা। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট ৭৫ বছর বয়সে প্রাণ মৃত্যুবরণ করেন।
মুম্বই এর ‘স্যার জামসেতজী জীজাভয় স্কুল অফ আর্ট’ এর একজন অপ্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র হিসেবে তথা ব্যক্তিগত প্রয়াসে তিনি চারুকলা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। নিজের শৈশব থেকে লালনকৃত প্রতিভাকে আরও শাণিত করার পাশাপাশি একই সময়ে তিনি ‘পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি’তে রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিষয়েও পড়াশোনা করতে থাকেন। কিন্তু একমাত্র স্কেচিং এর প্রতিই ছিল তার একনিষ্ঠ আগ্রহ আর একারণেই তিনি কমিক্স এর জগতে নিজের পেশা বেছে নেন। তিনি বরাবরই লেখক ও চিত্রশিল্পীদের চেয়ে কার্টুনিস্টদের বেশি পছন্দ করতেন, কারণ একমাত্র তারাই একই ক্ষেত্রে লিখতেও পারে এবং ছবিও আঁকতে পারে।
যাত্রার শুরু
“কারও কাছেই লেকচার শোনার মত সময় নেই। আমার তৈরি সকল চরিত্রই সাধারণ মানুষ- পিঙ্কী ৫ বছর বয়সের দুষ্টু একটি মেয়ে, বিল্লু একজন ক্রিকেট প্রেমী আর শ্রীমতিজি একজন মধ্যবিত্ত গৃহিণী।” - প্রাণ কুমার শর্মা, মরহুম ভারতীয় কমিক্স লেখকযখন সুপারম্যান আর ফ্যান্টমের পাশাপাশি বেলবটম প্যান্টস্ ও দ্য বিটলস্ এর তালে ভারতীয় সংস্কৃতি তাল মিলিয়ে চলছে, ঠিক এরকম একটি যুগেই প্রাণ এমন একটি চরিত্রের আবির্ভাব ঘটান যা শারীরিক শক্তি ও সামর্থ্যের জন্য নয়, বরং উপস্থিত বু্দ্ধি ও সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার কারণেই সকলের কাছে পরিচিতি লাভ করে এবং সমাদৃত হয়। আর এই চরিত্রটির নাম- চাচা চৌধুরী। চাচা কখনই তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি, জটিল কোনো সিদ্ধান্তও তিনি নেননি। তিনি জীবনকে এর স্বাভাবিক নিয়মেই মেনে নেন এবং আর দশজন সাধারণ ভারতীয়ের মতই নিজের সকল সমস্যা সহজ-সরল উপায়ে সমাধান করেন। আর এখানেই প্রাণ ভিন্নতা নিয়ে আসেন। তিনি ভারতীয়দের কাছে এমন একজন হিরো’কে উপস্থাপন করেন যার উচ্চতা মাঝারি আর দেহের গড়নও ছিল গড়পরতা এবং শুধুমাত্র বুদ্ধিমত্তা (চাচা’র) ছাড়া, তার অন্য কোনো ধরনের সুপারপাওয়ার তথা বিশেষ শক্তি ছিলনা।
তবে চাচা চৌধুরীর খুব সাধারণ এই দৈনন্দিন জীবনে একটি অসাধারণ বিষয় ছিল। আর তা হল তার সঙ্গী- জুপিটার থেকে আগত ভিনগ্রহের অধিবাসী, বিশালাকৃতির- সাবু। দুষ্টু লোকের মোকাবেলার ক্ষেত্রে চাচা’র শারীরিক শক্তির যে ঘাটতি ছিল তা এই সাবুই পূরণ করে দিত। সাবুর প্রতিবেলার খাবারেরতালিকায় থাকত ১০৮ টি রুটি, ২০ লিটার লাচ্ছি ও ১২ কেজি হালুয়া। ‘চাজ্জু চৌধুরী’ নামে চাচা’র একজন জমজ ভাইও ছিল। এই ভাইটিকেই মঙ্গল গ্রহবাসীরা ভুল করে চাচা মনে করে ধরে নিয়ে যায়। এই কমিক্স ধারাবাহিকের প্রথম ইস্যুটি বাজারের আসার সাথে সাথেই চমকপ্রদ সাফল্য লাভ করে; এমনকি, এক সপ্তাহের মধ্যেই এর প্রথম মুদ্রণ পুরোপুরি বিক্রি হয়ে যায়। আর এভাবেই যাত্রা শুরু হয় ভারতের প্রথম কমিক হিরো’র।
১৯৬০সালে দিল্লী থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘মিলাপ’ এর একজন কার্টুনিস্ট হিসেবে প্রাণ তার কর্মজীবন শুরু করেন। এই পত্রিকার জন্য ‘ডাবু’ ও ‘প্রফেসর অধিকারী’ নামক দুইটি চরিত্র নিয়ে তিনি একটি কমিক্স স্ট্রিপ লিখতেন। ১৯৬৯ সালে হিন্দী ম্যাগাজিন ‘লটপট’ এর জন্য তিনি প্রথম চাচা চৌধুরীকে তৈরি করেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা এই যে, চাচাকে বাস্তব জগতে আনার এক বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে তিনি ‘শ্রীমতিজি’কে তৈরি করেন। আর এভাবেই তার পঞ্চাশ বছরেরও বেশি দীর্ঘ কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। এই সুদীর্ঘ সময়কালে প্রাণের তৈরি ৪০০ কমিক্স বই ও কমিক্স এর জন্য নির্মিত ২০০,০০০ চিত্র প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ সালে ডায়মণ্ড কমিক্স তার তৈরি কমিক স্ট্রিপগুলিকে বই আকারে প্রকাশ করার প্রস্তাব করে।
“১৯৮১ সালে যখন আমি প্রথম প্রাণের সাথে যোগাযোগ করি তখন তিনি সংবাদপত্রের জন্য ছোট ছোট কার্টুন তৈরি করছিলেন। সেসময়ে ভারতের কোনো নিজস্ব কমিক্স ছিলনা, যা ছিল তার সবই বিদেশী কমিক্সের পুণর্নিমাণ। গত ৩৫ বছর ধরে একমাত্র আমরাই তার কার্টুন প্রকাশ করে আসছি।” - শ্রী গুলশান রায়, প্রকাশক, ডায়মণ্ড কমিক্স (২০১৪)এই প্রতিভাধর কার্টুনিস্টের সৃষ্ট অন্যান্য বিখ্যাত চরিত্রগুলি হল বিল্লু, পিঙ্কী ও রমন। সমাজের বিশেষ শ্রেণীর কথা মাথায় রেখেই প্রাণ তার কার্টুন চরিত্রগুলি তৈরি করেন যেমন শ্রীমতিজি একজন সাধারণ ভারতীয় গৃহিণী, চাচা হলেন এলাকার বা যৌথ পরিবারের জ্ঞানী প্রৌঢ়, বিল্লু প্রতিবেশী ছেলেদের সাথে খেলা ‘গলি ক্রিকেট’ এর একজন নিয়মিত খেলোয়াড়, পিঙ্কী হল অনবরত কথা বলতে থাকা ছোট্ট একটি মেয়ে আর রমন শ্রমজীবি মানুষের প্রতিনিধি। এই চরিত্রগুলোর সম্পর্কে খুব গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয় হল (১) সব সময় চুল দিয়ে ঢাকা থাকে বলে আজ পর্যন্ত কেউ বিল্লুর চোখ দেখেনি, এবং (২) চাচা চৌধুরীর পোষা কুকুর ‘রকেট’ পৃথিবীর একমাত্র নিরামিষভোজী কুকুর।
প্রতিভার সমাদর
প্রাণ কুমার শর্মা ছিলেন ভারতীয় কমিক্সের পথিকৃৎ, তার কীর্তি ভারতের বাইরেও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ভারতের ৩০ টিরও বেশি সংবাদপত্র ও পাক্ষিকে তার কমিক স্ট্রিপ প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ‘ইন্টারন্যাশনাল মিউজিয়্যাম অফ কার্টুন আর্টস’ চাচা চৌধুরী’র দু’টি পর্বের স্বত্ত্ব কিনে নিয়েছে। ভারতের কমিক্স জগতে তার অবদানের জন্য ‘লিমকা বুক অফ রেকর্ডস’ ১৯৯৫ সালে তাকে ‘পিপল অফ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। ২০১৪ সালের প্রথমদিকে ‘ওয়ার্ল্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ কমিক্স’ তাকে ‘ভারতের ওয়াল্ট ডিজনী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। ২০০১ ‘ইণ্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ কার্টুনিস্ট’ তাকে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ তথা আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করে।
সাধারণ শিল্প ও অকৃত্রিম হাস্যরসের প্রতিভার মাধ্যমে প্রাণ কুমার শর্মা পাঁচ দশকেরও বেশি সময় যাবৎ ভারত ও ভারতের বাইরের বেশ কিছু দেশের কমিক্স প্রেমীদের বিনোদনের খোরাক যুগিয়েছেন। তার তৈরি চরিত্রগুলিকে বাস্তব জীবনের সাধারণ পরিবারের সদস্যদের সাথে অনায়াসেই মিলানো যায়। আর এভাবেই তার চরিত্রগুলিকে কোনোরকম সুপারপাওয়ার না দিলেও, তিনি নিজে পাঠকদের হৃদয়ে একজন সুপারহিরো হিসেবেই জায়গা করে নিয়েছেন।
ইংরেজিতে পড়ুন: Pran Kumar Sharma: the Creator of Iconic Indian Comics