ঢাকার রাস্তায় একসময় বেবি ট্যাক্সি চলতো...

রফিকুল ইসলাম সাগর  বিডি.টুনসম্যাগ.কম ভাঙ্গা গড়ার এই শহরে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে পুরোনো সব স্থাপনা। পথ-ঘাট, ঘর-বাড়ি ...




রফিকুল ইসলাম সাগর 
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
ভাঙ্গা গড়ার এই শহরে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে পুরোনো সব স্থাপনা। পথ-ঘাট, ঘর-বাড়ি কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। নতুন নতুন স্থাপনার ভিড়ে আজ হারিয়ে গিয়েছে আমাদের অতীত। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে যারা বিদেশে গিয়েছে এখন পাঁচ বছর পর তারা দেশে ফিরে পরিবর্তনের মাঝে নিজের এলাকাই চিনতে পারেন না। বিদেশের কথা বাদ দিলাম ঢাকা শহরে থেকেই পাঁচ বছর আগে যেই এলাকায় গিয়েছি হটাৎ এখন সেই এলাকায় গেলে অচেনা মনে হয়। এই তো সেদিন মেয়েকে নিয়ে শাহবাগের শিশু পার্কে গিয়ে দেখি শিশু পার্ক আর নেই। পরে মনে পড়ল কয়েকমাস আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম শিশু পার্ক ভেঙে ফেলার খবর। শিশু পার্ক ভেঙে ফেলায় আমার মনে হলো, এই শহরে গরিবের আর কিছুই থাকলো না। শহরে এখন সব কিছুতেই বানিজ্য, এখানে থাকতে হলে টাকা খরচ করতে হবে। এখানে সস্তায় বিনোদন পাওয়া যাবে না তাই শিশু পার্কটাও হারিয়ে গেল। হয়তো ভবিষ্যতে শিশু পার্ক নিয়ে ভিন্ন কোন পরিকল্পনা থাকতে পারে কর্তৃপক্ষের। তবে নতুন করে সরকারি ভাবে শিশু পার্ক যদি চালু করাও হয় সেখানে বিনোদনের জন্য খরচ করতে হবে চড়া মূল্য এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। 

কি বলব লজ্জার কথা জন্মগত ঢাকাইয়া হওয়ার পরেও কয়েকদিন আগে তেজগাঁও রেল স্টেশনের পাশে মোটরসাইকেল নিয়ে একটি রাস্তা খুঁজতে গিয়ে পথ ভুলে নিজেই হারিয়ে গিয়েছিলাম। যে রাস্তা দিয়ে নাখালপাড়া হয়ে মহাখালী আসা যেতো। পরে মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে ফিরে এসেছি। অনেক দিন যাতায়াত না থাকায় বুঝতে পারিনি হারিয়ে ফেলা তেজগাঁওয়ের সেই রাস্তাটি এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে। আশেপাশের টিন শেডের বাড়ি গুলো সব বিল্ডিং হয়ে গেছে। চেনার উপায় নেই। এখন আবার দেখলাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচ দিয়ে মহাখালী-নাখালপাড়া অংশে দুই রেললাইনের দুপাশে আরও একটি করে নতুন রেললাইন স্থাপনের কর্মজজ্ঞ শুরু হয়েছে। 



তবে শহরের অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও সোনারগাঁও হোটেলের সামনে সেই 'সার্ক ফোয়ারা' এখনো আছে। ফোয়ারার উপর দিয়ে মেট্রোরেল পথের ওভারব্রিজ গেলেও ফোয়ারা আগের জায়গাতেই আছে। এই ফোয়ারার সামনে দিয়ে যতবার যাওয়া-আসা করি ততবার আমার বাবা মায়ের সাথে ছোটবেলায় কর্নফুলী ট্রেনে করে চট্টগ্রাম ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়। সেই স্মৃতি শেয়ার করার আগে এই ফোয়ারার সংক্ষিপ্ত তথ্য জেনে নেওয়া যাক। সার্ক ফোয়ারা। রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত একটি ফোয়ারা। এটি প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলের সামনে অবস্থিত। ১৯৯৩ সালে এটি নির্মিত হয়। এটির নকশাকারী হলেন নিতুন কুণ্ডু (১৯৩৫-২০০৬)।

সম্ভবত ১৯৯৫ সালের কথা। অনেক ছোট ছিলাম। যতদূর মনে পড়ে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে করে ঢাকা ফিরে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বেবি ট্যাক্সিতে করে মায়ের কোলে চেপে আমাদের বাসায় আসার সময় সোনারগাঁও মোড়ের এই 'সার্ক ফোয়ারা' দেখে বুঝতে পারতাম আমাদের বাসার কাছে চলে এসেছি। সেই যুগে এই ফোয়ারা থেকে পানি বের হওয়ার দৃশ্য অদ্ভুত সুন্দর লাগতো। এবং অবাক হয়ে ছোট্ট মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক করতো এখানে কিভাবে? কোথা থেকে পানি ঝরে? পানি শেষ হয়না? এসব প্রশ্ন মাকে করতাম। এছাড়া ফোয়ারার চারপাশে রঙিন বাতি জ্বলতো। যা আমার ছোট্ট হৃদয়ে আকর্ষণ করতো বেশি। এখন এই ফোয়ারা দেখলেই ছোটবেলার সেই স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে হয় এই তো সেদিন বেবি ট্যাক্সিতে করে বাসায় গিয়েছি। তখন অবশ্য জানতাম না এর নাম সার্ক ফোয়ারা। বলতাম ঝর্ণা। 

বড.... বড... শব্দ করে চলা সেই বেবি ট্যাক্সির কথা মনে আছে তো? এখন যেই সিএনজি অটোরিকশা তখন ছিল বেবি। সম্ভবত ডিজেলে চলতো। ঠিক মনে নেই। বেবি মাঝে মাঝে পুরোনো বাংলা সিনেমা দেখলে দেখা যায়।‌ পরিবেশ দূষণ করে বলে ঢাকা শহরের রাস্তায় বেবি চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে এলো সিএনজি অটোরিকশা। এখনো দেশের কোথাও বেবি চলাচল করে কিনা জানা নেই। ঢাকায় বেবি চলাচল নিষিদ্ধ করার পর বেশ কয়েকবছর গ্রামে গঞ্জে চলাচল করেছে। গ্রামের মহাজনেরা ঢাকা থেকে পুরোনো বেবি কিনে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। তখন দেশের অনেক গ্রামে বেবিই ছিল ইঞ্জিল চালিত প্রথম বাহন। ঢাকায় চলাচল বন্ধ হওয়ার কারণে এমন অনেক গ্রামে বেবি চলে যায় যেসব গ্রামের মানুষের কাছে তার আগে বেবি ছিল স্বপ্নের মতো। শহরের বাহন গ্রামে যাওয়ার পর মানুষের কৌতূহলের শেষ ছিল না। একটা সময়ে এসে আস্তে আস্তে আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে বেবি ট্যাক্সি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শহর থেকে অজপাড়া গাঁয়ে এখন সেই বেবির বিকল্প ইজি বাইক ও সিএনজি অটোরিকশা। 

বেবি নিয়ে ছোট একটি গল্প শেয়ার না করলেই নয়। কয়েকমাস আগে এক বন্ধুর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম নরসিংদীর এক গ্রামে। যাওয়ার পর দেখে মনে হলো মেয়ের বাপ মোটামুটি ভালোই টাকাওয়ালা। মেয়ের বাপের কথা-বার্তায় বড়লোকীর অহংকারী একটা ভাব কাজ করে। মনে হলো নতুন নতুন বড়লোক হয়েছেন। মেয়ের বাপের অহংকার দেখে ঘটককে প্রশ্ন করলাম! উনি নতুন নতুন বড়লোক হয়েছেন? নাকি আগে থেকেই বড়লোক? তো মেয়ের বাপ যে আগে থেকেই বড়লোক সেটা বোঝানোর জন্য ঘটক আমাদের বললেন, মেয়ের বাপের নাকি ২০০৪ সালে একটা বেবি ছিল। প্রাইভেট বেবি। তিনি সব সময় নিজের বেবিতে করেই এদিক সেদিক যাতায়াত করতেন। সেই আমলের এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকায় পুরাতন বেবি কিনেছিলেন। সেই সময় ওই এলাকায় নাকি কারো প্রাইভেট বেবিও ছিল না। ঘটকের কথা শুনে জানতে চাইলাম, সেই বেবি এখন আছে? 
ঘটক বলল, মেয়ের বাপ একদিন তার প্রাইভেট বেবিতে চড়ে পাশের গ্রামে এক বিচার করতে যাচ্ছিল। ঘটকের ভাষ্য মতে চালক গাঁজা খেয়ে বেবি চালাচ্ছিলেন। চলতে চলতে হটাৎ পেছনের সিটে বসে থাকা মেয়ের বাবাসহ চালক বেবি নিয়ে রাস্তা ছেড়ে খাদে পড়ে গেলেন। চালক লাফ দিয়ে আগেই পড়ে যাওয়ায় তার তেমন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু মেয়ের বাবা কোমড় ভেঙ্গে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। এরপর থেকে তিনি আর কোনদিন বেবিতে উঠেন না। দুর্ঘটনার পর তার সেই বেবি মাত্র ত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন। এছাড়া এরপর থেকে তিনি কোন ড্রাইভারকে বিশ্বাস করেন না বলে গাড়ী কিনেন না। তার ভাষ্য মতে সব ড্রাইভাররা ইতর, বদমাইশ। 

এই বিভাগে আরো আছে

প্রবন্ধ 8757654887621443618

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সঙ্গে থাকুন

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক

বৈশিষ্ট্যযুক্ত

বিশ্বসেরা ১০ কার্টুনিস্ট

শিল্পী রফিকুননবী সাধারণ মানুষের কাছে যতটা না তার ফাইন আর্টসের জন্য পরিচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় তার ‘টোকাই’ কার্টুন চরিত্রের জন্য। এ ...

-

  • ফেসবুকে অনুসরণ করুন

    আঁকা-আঁকি আহ্ববান

    আপনার আঁকা, মজার মজার লেখা, ছবি আঁকার কলা-কৌশল, শিল্পীর জীবনী, প্রবন্ধ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অথবা প্রদর্শনীর সংবাদ টুনস ম্যাগে ছাপাতে চাইলে পাঠিয়ে দিন। আমাদের ইমেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।

    সহায়তা করুন

    item