বিল ওয়াটারসন: কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতার ব্যাপারে আপোষহীন
![](https://img2.blogblog.com/img/icon18_edit_allbkg.gif)
https://bd.toonsmag.com/2019/09/blog-post_28.html
![]() |
time.com |
“বাস্তবে চাকুরি করা মানে সেই কাজটিই করা, যা করতে আমরা পছন্দ করিনা।”
- বিল ওয়াটার্সন
আজকের দিনে, ‘চাকুরি/কাজ’, হয়তো, সামগ্রিকভাবে সবচেয়ে অপছন্দের শব্দ। কেউই যেন কাজে যেতে পছন্দ করে না, ‘মানডে ব্লু’ নামক সমস্যাটি রীতিমত মহামারির আকার ধারণ করেছে; আর এমন কিছু খুঁজে বের করা যা ‘শুধু অর্থনৈতিক উপার্জনই নয়, বরং মনের শান্তিরও খোরাক হতে পারে’- প্রতিটি মানুষের কাছেই প্রায় অসাধ্য একটা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে যার দায়িত্ব সবাই নিজ নিজ ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছে। ‘পছন্দের কাজ ও পেশা’- দুই মেরুতে অবস্থানরত এই দুইটি শব্দ- জীবনে আমাদের পরিচিতি তৈরির জন্য প্রয়োজন। আর যদি কোনো একজন মানুষ এই দুইটি শব্দের মাঝে একটি ভারসাম্য স্থাপন করতে সমর্থ হয়- তাহলে আজকের সমাজে সে-ই সফল মানুষ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
তবে আশার কথা এই যে এই ধরনের সফল মানুষ খুঁজে পাওয়া ততটাও কঠিন নয়, যতটা মনে হচ্ছে। কার্টুনিস্ট বিল ওয়াটার্সন সেসকল হাতে গোণা সফল মানুষদেরই একজন। কর্মজীবনের শুরুর দিকে বেশ কিছু বাজে ব্যর্থতার পরেও, শুধুমাত্র কঠোর অধ্যবসায় ও নিয়মিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার দ্বারাই তিনি তার কমিক স্ট্রিপ ‘ক্যালভিন এণ্ড হবস্’- যা একটি ছেলে ও তার কাল্পনিক বন্ধু একটি খেলনা বাঘ কে নিয়ে রচিত- এর মাধ্যমে বর্তমানের সফলতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রাথমিক জীবন
উইলিয়াম বয়ড ওয়াটার্সন এর জন্ম ১৯৫৮ সালের ৫ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসি তে। বর্তমানে তিনি তার স্ত্রী’র সাথে ক্লীভল্যাণ্ডে বসবাস করছেন। তিনি খুবই শান্তিপূর্ণ ও সাদামাটা জীবন যাপন করছেন এবং যে কোনো ধরনের সাক্ষাৎকার দিতেই অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তার বাবা জেমস্ ওয়াটার্সন ছিলেন একজন প্যাটেন্ট বিষয়ক আইনজীবি। মাত্র ৬ বছর বয়সে বিল তার বাবা মায়ের সাথে ওহাইও’র শ্যাগ্রিন ফল্স এ চলে আসেন। তার মা ক্যাথরিন সেখানকার সিটি কাউন্সিলের নির্বাচনে একটি আসনে বিজয়ী হয়ে কাজ শুরু করেন। তার বাবাও প্রায় ৩০ বছর পরে শ্যাগ্রিন ফল্স সিটি কাউন্সিলে কাজ করতে শুরু করেন।
![]() |
comicartfans.com |
বিল সব সময়ই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সালে ওহাইও কেনিওন কলেজ এ ভর্তি হন। সেখানে থাকা অবস্থায় ৪ বছর তিনি ‘কলেজিয়ান ক্যাম্পাস নিউজপেপার’ এ রাজনৈতিক বিষয়ে কার্টুন আঁকার কাজ করতেন। একই সাথে, দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালে কয়েক সপ্তাহ যাবৎ তিনি তার ডর্ম রুমের সিলিং এ মাইকেল্যাঞ্জেলো’র ‘ক্রিয়েশন অফ অ্যাডাম’ এর একটি কপি থেকে ছবি আঁকেন। অন্যান্য সফল কার্টুনিস্টদের মতই বিলও বেশ অল্প বয়সেই আঁকাআঁকি বিষয়ে তার প্রতিভার পরিচয় দেন। যদিও তার রচিত চরিত্র ক্যালভিন এর মত তার নিজের ছোটবেলায় কোনো কাল্পনিক বন্ধু ছিলনা, কিন্তু চার্লস এম. শুল্জ (‘পিনাটস্’ এর স্রষ্টা) এবং ওয়াল্ট কেলী (‘পোগো’র আঁকিয়ে) তাকে বেশ গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
ব্যর্থতা ও অধ্যবসায়ের সময়কাল
“পাঁচ বছর ধরে একটি উপযুক্ত চাকুরি খুঁজে না পাওয়ার ব্যর্থতা সহ্য করার জন্য হয় নিজের প্রতি বিভ্রান্তিকর আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে, অথবা কাজটার প্রতি একান্ত ভালবাস থাকতে হবে। আমি আমার কাজকে একান্তভাবে ভালবাসতাম।”
- বিল ওয়াটার্সন, ১৯৯০ সালে কেনিওন কলেজের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলা
বিল ১৯৮০ সালে কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন এবং প্রায় সাথে সাথেই ‘সিনসিনাট্টি পোস্ট’ এ এডিটরিয়্যাল কার্টুনিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু তিনি কখনই রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলেন না এবং তার কাজে তা পরিষ্কারভাবেই প্রকাশ পেত। তিনি তার চেয়ে বয়সে বড় সহকর্মীদের দেখে ভাবতেন যে তার পক্ষে সারাজীবন শুধুমাত্র আর্থিক কারণে কোনো কাজ করে যাওয়া সম্ভব হবে কি না বা এরকম কোনো কাজ করলে তার জীবনের পরিণতি কী হবে। আর এভাবেই, এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তার কাজে একেবারেই খুশি না হওয়ায়, সংবাদপত্রের কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করে এবং তিনি তার বাবা-মায়ের সাথে বসবাস করার জন্য বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হন। সংবাদপত্রের চাকুরি ছেড়ে দেওয়ার পরে তিনি অনুধাবন করতে পারেন যে তিনি কখনই রাজনীতি নিয়ে কাজ করতে চাননি, আর তাই তিনি আবারো নিজের প্রকৃত আগ্রহের বিষয় তথা কমিক স্ট্রিপ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন।
এই সময়টা ছিল তার কঠোর অধ্যবসায় ও নিয়মতি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পরীক্ষার শুরু এবং এই সময়টা দীর্ঘ ৫ বছর স্থায়ী ছিল। এই পুরো সময় জুড়ে তিনি সিণ্ডিকেটে তার কমিক স্ট্রিপ পাঠাতে থাকেন এবং প্রতিনিয়ত নেতিবাচক উত্তর লাভ করতে থাকেন। তিনি জানতেন যে এভাবে বাস্তবে জীবন ধারণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু তারপরেও তিনি তার স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা বন্ধ করেননি এবং যতদিন পর্যন্ত পছন্দসই কোনো কাজ না জুটে ততদিন পর্যন্ত জীবন ধারণের জন্য তিনি একটা ভারসাম্য খুঁজে নেন। মাসিক খরচ চালানোর জন্য তিনি একটি গাড়ী বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ও মুদির দোকানের জন্য বিজ্ঞাপণ তৈরির কাজ করতে থাকেন এবং একই সাথে কমিক স্ট্রিপ তৈরির কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। এভাবে মোট ৬ টি কমিক স্ট্রিপ তৈরি করে ইউনাইটেড ফিচার্স সিণ্ডিকেট এর কাছে পাঠান আর এর সব কয়টিই ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালে ‘ক্যালভিন এণ্ড হবস্’ এর রচনা ও প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে সফলতার শুরু হয়।
‘ক্যালভিন এণ্ড হবস্’ এর সাথে এক দশক
“যদি আমি স্ট্রিপটির জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে আরও ৫, ১০ বা ২০ বছর এটি চালিয়ে যেতাম তাহলে আজ যারা ‘ক্যালভিন এণ্ড হবস্’ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে ‘দু:খ’ প্রকাশ করছে, তারাই আমাকে ভর্ৎসনা করত এবং তরুণ, নতুন শিল্পীদের পরিবর্তে আমার রচনার মত পুরনো, সেকেলে কমিক স্ট্রিপ প্রকাশের জন্য সংবাদপত্রগুলোকে তিরস্কার করত। আর আমিও তাদের সাথে একমত হতাম।”
- বিল ওয়াটার্সন
৫ বছর ধরে বিল বেশ কয়েকটি চরিত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং মোট ৭ টি কমিক স্ট্রিপ রচনা করেন। ৭ম টি-কেও ব্যবসায়িকভাবে সফল হতে পারবে না ভেবে ইউনাইটেড ফিচার্স সিণ্ডিকেট ফিরিয়ে দেয়, কিন্তু ইউনিভার্সাল প্রেস সিণ্ডিকেট এটিকে সাদরে গ্রহণ করে এবং ১৯৮৫ সালে এটি প্রকাশ করে। বিল ওয়াটার্সনের বয়স তখন মাত্র ২৭ বছর। আর এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের কমিক স্ট্রিপের সর্বকালের ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় একটির যাত্রা শুরু হয়।
![]() |
nerdbastards.com |
‘ক্যালভিন এণ্ড হবস্’ মাত্র ১০ বছর যাবৎ পাঠকদের বিনোদনের খোরাক যুগিয়েছিল! বিশ্বাস হচ্ছেনা, তাই না? কিন্তু এটাই বাস্তবে ঘটেছে এবং এটা ছিল সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত একটি সিদ্ধান্ত। বিলের উপরোক্ত উক্তিটিই তার এই সিদ্ধান্তকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট হলেও, পাঠকেরা স্বভাবতই এই ঘটনায় মোটেও খুশি হয়নি। কিন্তু এই ধারাবাহিকের ব্যাপারে বিলের সিদ্ধান্তকে কোনোভাবেই পরিবর্তন করা সম্ভব ছিলনা। আর এই কারণেই এই কমিক স্ট্রিপের কোনো অনুমতিপ্রাপ্ত যথার্থ মার্চেণ্ডাইজ নেই।
‘ক্যালভিন এণ্ড হবস্’ এর গল্প রচিত হয়েছে ৬ বছর বয়সী একটি চঞ্চল বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে যার চিন্তাচেতনা বেশ হতবুদ্ধিকর; কখনো কখনো সে তার বয়সের একজন শিশুর মতই স্বাভাবিক আচরণ করে, আবার কখনো তার কথাবার্তা তার চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক, জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তির কথার মত মনে হয়। আর হবস্ ছিল তার কাপড়ের তৈরি খেলনা বাঘ যে শুধুমাত্র তখনই জীবিত রূপ ধারণ করত যখন ক্যালভিন এর সাথে একান্তে থাকত এবং সে একজন জ্ঞানী পরামর্শদাতার মতই ছিল। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের উপযু্ক্ত চরিত্রের মাধ্যমে গল্পগুলি প্রকাশিত হলেও এর মাধ্যমে লেখক এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করেছিলেন যা পাঠকদের গভীরভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করত। এটা অনেকেরই অজানা যে বিল পড়তে খুব ভালবাসেন এবং তিনি দর্শনশাস্ত্রের একজন বড় ভক্ত। এমনকি, তার এই কমিক স্ট্রিপের প্রধান চরিত্র দু’টির নাম তার প্রিয় দু’জন দার্শনিক ও চিন্তাবিদের নামানুসারেই রাখা হয়: ধর্মবিদ জন ক্যালভিন ও দার্শনিক থমাস হবস্।
“এই দূরদেশে পাথরের তৈরি এই পাঠাগারে বসে ঐসকল মোটামোটা দর্শনের বই পড়লে হয়তো কোনো চাকুরি যোগাড় করা সম্ভব নয়, কিন্তু ঐ বইগুলি যদি তোমার নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে যে কীভাবে জীবনকে সত্যিকার অর্থে অর্থবহ ও কর্মবহুল করে তোলা যায়, তাহলে নিজের মানসিকতা ও চিন্তাচেতনাকে যথার্থভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় উপায় তোমার কাছে রয়েছে, যা সব সময়ই কাজে লাগবে।”
- বিল ওয়াটার্সন
‘ক্যালভিন এণ্ড হবস্’ রচনার কারণে ১৯৮৬ সালে বিল ওয়াটার্সন এই শিল্পের সবচেয়ে বড় পুরস্কার- ন্যাশনাল কার্টুনিস্ট সোসাইটি’র ‘দ্য রুবেন অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট কার্টুনিস্ট’- লাভ করেন। এই সম্মান অর্জনকারী কার্টুনিস্টদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয় কম বয়সী। এই কমিক স্ট্রিপটির বিপুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ইউনিভার্সাল প্রেস সিণ্ডিকেট এর মার্চেণ্ডাইজ তৈরি করার প্রস্তাব করে, কিন্তু বিল তা নাকচ করে দেন কারণ তিনি তার তৈরি এই চরিত্রগুলোকে কোনোরকম ব্যবসায়িক কাজে নয়, বরং শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করার কাজেই ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।
![]() |
pop.inquirer.net |
এই কারণেই এই ধারাবাহিকের কোনো অনুমতিপ্রাপ্ত যথার্থ মার্চেণ্ডাইজ নেই; যদিও বাজারে অনেক অবৈধ ও নকল মার্চেণ্ডাইজ পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, ১৯৯৫ সালে পাঠকদের মন ভেঙ্গে দিয়ে বিল ঘোষণা দেন যে শুরু করার মাত্র ১০ বছর পরেই তিনি এই স্ট্রিপটির রচনা বন্ধ করতে চলেছেন। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৫ সালেই এই কমিক স্ট্রিপটি শেষবারের মত প্রকাশিত হয়। এই দুইটি ঘটনার মাধ্যমেই এটা প্রমাণ হয় যে বিল তার কাজের ব্যাপারে কতটা একনিষ্ঠ ছিলেন এবং তিনি তার কাজকে কতটা ভালবাসতেন। তার কাজের পিছনে কোনোরকম আর্থিক অনুপ্রেরণা ছিলনা।
পরবর্তী জীবন
২০১৪ সালে বিল আবারো লেখালেখির জগতে ফিরে আসেন। পার্কিনসন্স রোগের মোকাবিলা করার জন্য অর্থ যোগানের জন্য তিনি কার্টুনিস্ট স্টিফেন প্যাস্টিস এর সাথে ‘পার্ল বিফোর সোয়াইন’ রচনা করেন। এছাড়াও তিনি ‘স্ট্রিপড্’ নামক একটি ডক্যুমেন্টারির জন্য পোস্টার নির্মাণের কাজও করেছিলেন।
![]() |
theverge.com |
বর্তমানে তিনি ক্লীভল্যাণ্ডে তার স্ত্রীর সাথে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করছেন। ‘ক্যালভিন এণ্ড হবস্’ এত দ্রুত শেষ করে দেওয়ার ব্যাপারে তার কোনোরকম অনুতাপ নেই, যদিও ধারাবাহিকটি খুব বেশিদিন প্রকাশিত হয়নি এবং পাঠকেরা তখনও এর থেকে আরও অনেক কিছু প্রত্যাশা করছিল। তার নিজের ভাষাতেই বলতে হয়:
“শেষ হয়ে যাওয়ার অনেক আগেই পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা বরাবরই উত্তম সিদ্ধান্ত।”