রঙ তুলিতে আঁঁকা জীবন
বিডি.টুনসম্যাগ.কম তুলি হাতে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র আঁঁকলেও বাস্তব জীবনে মাহবুব ও লিপি একই ফ্রেমে বন্দী। কথা হয় এই শিল্পী দম্পতির সাথে। ...
https://bd.toonsmag.com/2015/01/15246.html
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
তুলি হাতে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র আঁঁকলেও বাস্তব জীবনে মাহবুব ও লিপি একই ফ্রেমে বন্দী। কথা হয় এই শিল্পী দম্পতির সাথে।
ইমরান হোসাইন
সভ্যতার পথে মানুষের প্রথম পদক্ষেপ ছিল শিল্পচর্চা। শিল্পের সারণি ধরেই ক্রমাগত যাপিত জীবনের উত্তুঙ্গ শিখরকে স্পর্শের সমর্থতা তৈরি হয়েছে আজকের উত্তরাধুনিক মানুষের। শিল্প সৃষ্টির প্রয়াস এক সুদীর্ঘ সাধনার নান্দনিক রূপায়ণ। দীর্ঘ সময়ের ভাবনা, বেঁচে থাকার যাতনাকে সরলীকরণের প্রচেষ্টায় প্রাগৈতিহাসিক মানবসন্তান তাঁর অনুভূতিকে অন্ধকার গুহায় বিবৃত করেছে রং-রেখার নানাবিধ সরল বিন্যাসে। প্রত্নমানবের সীমিত উপকরণ, নিজস্ব করণকৌশল বিশাল পরিধিতে বিবৃত হয়েছিল আশ্চর্য দক্ষতায়! প্রকৃতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল ছবি আঁঁকা, প্রকৃতিই ছিল তাঁদের আঁঁধার-আঁঁধেয় এবং আরাধনা। তাই এই শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বতঃস্ফূর্ত। অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান তাদের শিখিয়েছে আটপৌরে জীবন ও শিল্পচর্চা একে অন্যের পরিপূরক। প্রত্নপ্রস্তর যুগে মানুষ নিজেকেই প্রত্যক্ষণ করেছে; প্রত্যক্ষণ করেছে তাঁর আরাধ্য জীবনধারণকে। হাজার হাজার বছর পরে ছবিতে মুহূর্তকে উপস্থাপনের প্রবণতা আমাদের পূর্বপুরুষদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। তবে প্রাচীন মানুষ নান্দনিকতা নয় বরং জীবনের কঠিন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকেই এঁকেছেন। নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষের স্বাধীন সত্তার পরিবর্তন হয়। তারা অভিজ্ঞতার পাশাপাশি নান্দনিক ও কাল্পনিক চিত্রই এঁকেছেন। বর্তমান সময়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় শিল্প এখন পূর্ণতা লাভ করেছে। শিল্পসৃষ্টির বহু পথ ও মতের মানুষ আজ সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শিল্পচর্চা ও মননশীল মানুষের রুচি নির্মাণে ভূমিকা রাখছে। যে সকল শিল্পীদের হাত ধরে বর্তমান শিল্পে ভিন্ন উত্তরণ ঘটেছে সে সকল শিল্পীদের মধ্যে তৈয়বা বেগম লিপি ও মাহবুবুর রহমান অগ্রগণ্য। তুলি হাতে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র আঁঁকলেও বাস্তব জীবনে তারা একই ফ্রেমে বন্দী। কথা হয় এই শিল্পী দম্পতির সাথে। দরজা খুলে বাসায় পা রাখতেই মনে হল কোন শিল্পকর্ম-প্রদর্শনীতে চলে আসলাম। শিল্পী যেমন রং তুলি দিয়ে আপন মনে ক্যানভাস রাঙ্গিয়ে তুলেন তেমনি ঘরখানা সাজিয়ে রেখেছেন। প্রথমেই কথা হয় তৈয়বা বেগম লিপির সঙ্গে, লিপির জন্ম ১৯৬৯ সালে গাইবান্ধা জেলায়। বারো ভাইবোনের মধ্যে লিপি এগারো নম্বর। গাইবান্ধায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে। চারুকলার পাঠ চুকিয়ে শিল্পকর্মের দিকে মনোনিবেশ করেন এই শিল্পী। আমাদের দেশের অধিকাংশ নারীর জীবন-যন্ত্রণার প্রতিফলন ঘটেছে এই শিল্পীর কাজে। আমাদের দেশে সংসারের মূল ভূমিকা পালন করতে হয় সংসারকর্তী নারীকে। রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালন, স্বামীসেবা, হাঁস-মুরগি পালন, অতিথি আপ্যায়ন, এমনকি বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ পর্যন্ত বিস্তৃত নারীর কর্তব্য। এত করেও আবার সইতে হয় লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, কখনো কখনো সংসারকর্তার শারীরিক নির্যাতনও। এমন বঙ্গনারীরূপকে তুলে ধরেছেন লিপি। লোকায়ত বাংলার জীবনকে আমাদের প্রচলিত উপকরণ দিয়েই সাজিয়ে তুলেছেন তিনি। ব্লেড, ছিপটিফিন ছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহূত বস্তু স্থান পেয়েছে তার গড়া শিল্পকর্মে। একক শিল্পকর্ম-প্রদর্শনী ছাড়াও অংশগ্রহণ করেছেন দেশ-বিদেশের নানা শিল্পকর্ম-প্রদর্শনীতে। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশ-বিদেশ থেকে পেয়েছেন নানা পুরষ্কার। ২০১৪ সালে পেয়েছেন ‘ওয়ান অফ দ্য অনন্যা টপ টেন উইমেন অফ দ্য ইয়ার’ ইতালি পুরষ্কার এবং আমিনুল ইসলাম ট্রাস্ট থেকে ওয়ান ইয়ার ফেলোশিপ। সতের বছরের সংসার জীবনে ছিলেন একে অন্যের পরিপূরকের মত। লিপি বলেন, মাহবুবকে কখনই স্বামীর মত মনে হয়নি, আমরা বন্ধু ছিলাম এখনো বন্ধুর মতই আছি। ভালবাসার ঘর, সংসার আর শিল্প এই নিয়েই আমাদের পথচলা। শিল্পী মাহবুবুর রহমানের জন্ম পুরান ঢাকায়। ছোটবেলায় পড়াশুনার পাশাপাশি ছবি আঁঁকার দিকে প্রচন্ড জোক থাকায় ভর্তি হয়েছিলেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে। মাহবুব বলেন, স্কুল ফাঁকি দিলেও কখনো ফাঁকি দেইনি ছবি আঁঁকার ক্লাস। গুণী এই শিল্পী ১৯৮৬ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে। ১৯৯৬ সাল থেকে একত্রে শিল্পচর্চা শুরু করেন এই শিল্পী দম্পত্তি । মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশের নিরীক্ষাধর্মী শিল্পের সঙ্গে যন্ত্র সংযোগ করেছেন। দুজনে মিলে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বৃত্ত আর্ট ট্রাস্ট’। শিল্পী মাহবুব তার শিল্পকর্মের জন্য জাতীয় পুরষ্কার ছাড়াও পেয়েছেন নানা স্বীকৃতি । সমপ্রতি জাপানে শিল্পকর্ম-প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন এ দম্পতি। মাহবুব ও লিপি মনে করেন, যে কোন পেশাতেই সত্ ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে সফলতা আসবেই। দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত