শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এর জন্মদিবস আজ
বিডি.টুনসম্যাগ.কম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন (জন্ম: ২৯ ডিসেম্বর, ১৯১৪ - মৃত্যু:২৮ মে, ১৯৭৬) বাংলাদেশের শিল্পজগতের দুয়ার খুলতেই জ্বলজ্...
https://bd.toonsmag.com/2014/12/29209.html
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন (জন্ম: ২৯ ডিসেম্বর, ১৯১৪ - মৃত্যু:২৮ মে, ১৯৭৬) |
বাংলাদেশের শিল্পজগতের দুয়ার খুলতেই জ্বলজ্বল করে ওঠে যার নাম, তিনি জয়নুল আবেদীন। তিনিই আমাদের চিত্রকলা ও লোকশিল্পের বর্ণাঢ্য ইতিহাসের রূপকার। আমাদের শিল্পাচার্য। বাংলার প্রকৃতি, জীবনাচার, ঐশ্বর্য, দারিদ্র্য এবং বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহা যিনি তুলি আর ক্যানভাসে বিশ্ববাসীর সামনে মূর্ত করে তুলেছিলেন, সেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন-এর জন্মদিবস আজ (২৯ডিসেম্বর)।
জাতীয় পর্যায়ে শিল্পাচার্যের জন্মশতবর্ষের বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ জাতীয় জাদুঘরে। ইতিমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। চারুকলার ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ হয়েছে। সকাল ১০টায় উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে শুরু হবে অনুষ্ঠানমালা। চারুকলার শিল্পীরা গাইবেন দুটি সমবেত সঙ্গীত। এর পর সম্মাননা প্রদান ও আলোচনা পর্ব। অনুষ্ঠানে চারুকলা অনুষদের বার্ষিক প্রদর্শনী ও শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হবে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে শিল্পাচার্যকে জন্মদিনের শুভাশিষ জানাবেন ইসমেখার আহমেদ ও আফসানা হোসেন মুমু। নজরুলসঙ্গীতের মাধ্যমে অঞ্জলি জানাবেন ঋতুপর্ণা সরকার। লোকসঙ্গীত গাইবেন মেহেদী হাসান আরিয়ান ও বৈজয়ন্তী সরকার। অন্যদের মধ্যে থাকছেন- অধ্যাপক ড. রফিকুল আলম, আব্দুস সাত্তার, অধ্যাপক শেখ আফজাল হোসেন, অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক, তমা, সুব্রিতা অলকা, নাজনিন ইসলাম, আব্দুর রহমান নূর, শাওন দাস প্রণয়, মেহনাজ তাবাস্সুম অনন্যা, রুবাইয়া, নদী, সৌরভ বিশ্বাস, সিঞ্চি প্রমুখ।
বিকেলের আয়োজনটিও হবে আকর্ষণীয়। এ পর্বে অংশ নেবেন চারুকলার পুরনোরা। দীর্ঘকাল পর তাঁরা পেছন ফিরে তাকাবেন। বলবেন হাসি আনন্দের স্মৃতি। এ পর্বের উপস্থাপক চিরসবুজ অভিনেতা আফজাল হোসেন। সন্ধ্যায় বসবে গানের আসর। এ পর্বে নাশিদ কামাল, কৃষ্ণকলিসহ জনপ্রিয় শিল্পরা সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। গাইবেন চারুকলার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়া ব্যান্ড মেঘদল, বাউলা, তনুশ্রী ও মাস্টারব্যান্ড।
এছাড়াও প্রত্যেক বিভাগ একটি করে গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারের আয়োজন করবে। এসব সেমিনারের মূল প্রবন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হবে জয়নুল আবেদিনকে। হবে বিস্তারিত আলোচনা।
শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে জয়নুলের কাজের বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে ছবি এঁকেছেন ১০০ শিল্পী। জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা ছবি নিয়েও আয়োজন করা হবে বিশেষ প্রদর্শনীর। তারও আগে মঙ্গলবার থেকে বেঙ্গল গ্যালারিতে শুরু হয়েছে জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহ থেকে নির্বাচিত নক্সিকাঁথার প্রদর্শনী। ময়মনসিংহেও বিশাল আয়োজনে উদ্যাপিত হচ্ছে জয়নুল জন্মশতবর্ষ।
শিল্পাচার্যের জন্মদিনে বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে নিয়মিতভাবে জয়নুল উৎসবের আয়োজন শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। ডিন নিসার হোসেন জানান, প্রথমদিকে ছাত্ররাই এর আয়োজন করত। উৎসবটি বড় আয়োজনে করা হচ্ছে ২০০৯ সাল থেকে। বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর পাশাপাশি প্রবর্তন করা হয়েছে জয়নুল সম্মাননা। যাঁরা শিল্পকলা চর্চা ও শিল্পশিক্ষার প্রসারে অবদান রেখেছেন তাঁদের সম্মানিত করা হচ্ছে। এবার সম্মাননা দেওয়া হবে শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী ও ভারতের বরদা এম এস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম মোহাম্মদ শেখকে। এ ছাড়া এবার ৫-৬ ও ১১-১২ জানুয়ারি চারটি সেমিনার হবে জাতীয় জাদুঘর ও ক্রাফট কাউন্সিলের সহায়তায়। এতে দেশের কলাতাত্ত্বিকদের পাশাপাশি ভারতের ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যলয়ের আদিবাসী শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ রাজেশ ভৌমিক এবং কলকাতার গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহশালার লোকশিল্প বিশেষজ্ঞ বিজন কুমার মণ্ডল গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে চারটা থেকে বকুলতলার মঞ্চে থাকছে শিল্পাচার্যের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, স্মৃতিচারণা ও সংগীতানুষ্ঠান।
বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য তাঁর জীবদ্দশায় তিনি পেয়েছেন 'শিল্পাচার্য' খেতাব। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলেন শুধু কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। এ আর্ট স্কুল দেখে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুল আবেদিনের মন বসছিল না। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের পড়ালেখা বাদ দিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে ভর্তি হন। জয়নুল আবেদিনের আগ্রহ দেখে তাঁর মা নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে আর্ট স্কুলে ভর্তি করান। পরে ছেলে জয়নুল আবেদিন মায়ের সেই ভালোবাসার ঋণ শোধ করেছেন দেশের স্বনামধন্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে।
জয়নুল আবেদিন ছিলেন এদেশের চিত্রশিল্প আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শুধু দুর্ভিক্ষের ছবি নয়, গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য, মা-মাটি এবং মানুষের জীবনের নানান বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তাঁর ছবির মাধ্যমে। তাঁর আঁকা জলচিত্রগুলোও পেয়েছে এক অসাধারণ ভিন্নমাত্রা। তাঁর প্রচেষ্টায়ই বাংলাদেশে শিল্প আন্দোলনের জয়যাত্রা শুরু।
'৪৭-এ উপমহাদেশে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলে তিনি পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। কলকাতা আর্ট স্কুলে তাঁর চাকরিটি ছেড়ে ঢাকার আরমানিটোলায় একটি স্কুলে আর্ট শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর শিল্পী খ্যাতি, অসাধারণ সাংগঠনিক মেধা; তৎকালীন শিল্পী, সহকর্মী ও বন্ধুদের সহযোগিতা এবং শিল্পাগ্রহী কিছু বাঙালি সরকারি কর্মকর্তার সহযোগিতা_ সব মিলিয়ে তিনি ১৯৪৮ সালে এদেশের প্রথম আর্ট স্কুল 'গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস' প্রতিষ্ঠা করেন। ৮ বছরের মাথায় মাত্র দুই কক্ষের সেই প্রতিষ্ঠানটিকে ১৯৫৬ সালে তিনি একটি আধুনিক শিল্পকলা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন। পরে এটি পূর্ব পাকিস্তান 'চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ 'চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়'-এ রূপান্তরিত হয়। তারপর মহাবিদ্যালয়টি সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তরিত হয় এবং বর্তমানে এটি 'চারুকলা অনুষদ' নামে পরিচিতি লাভ করে।
তাঁর আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা পৃথিবীবিখ্যাত চিত্রকর্মের সিরিজ। সেই দুর্ভিক্ষ বা মন্ব্বন্তর ঘটেছিল ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায়। বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের বেঙ্গল প্রদেশে যা 'তেতালি্লশের মন্বন্তর' নামেও পরিচিত। শিল্পাচার্যের দুর্ভিক্ষ সিরিজের সেই কালজয়ী চিত্রকর্ম বেঙ্গল গ্যালারির আয়োজনে স্থান পেয়েছে, যা দর্শকদের জয়নুল আবেদিনের অসামান্য শিল্প-সাধনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আরেকবার।
সেই তেতালি্লশের মন্বন্তর সম্পর্কে জয়নুল আবেদিন একবার বলেছিলেন, '১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ ছিলো মনুষ্যসৃষ্ট। একটি পরাধীন দেশে একটি বিদেশি শক্তির চক্রান্ত। তার একটা স্বতন্ত্র আবেদন ছিলো; তাই অন্তর থেকে ছবি আঁকার দুর্বার প্রেরণা ছিলো। সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও ধ্বংসলীলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এতে কারো হাত নেই তেমন। এতে দুঃখ হয় কিন্তু আবেদন ক্ষণস্থায়ী, তাই অধিকসংখ্যক উল্লেখযোগ্য ছবি হয়নি। আর এখন? এখন তো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটি স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের ছবি হয় না!'
জয়নুল আবেদিন ছিলেন আমাদের সেই প্রকৃত আলোকবর্তিকা, যিনি শুধু পথ প্রদর্শনই নয়, পথকে নিজ হাতে গড়ে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য; এই বাংলাদেশের জন্য। তিনি দিলি্ল বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডিলিট প্রাপ্তির ভাষণে বলেছিলেন, 'আমার সমস্ত জীবন ও কর্ম নিবেদিত ছিলো একজন সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার পথে।'