মরে যাওয়া রাতের গল্প
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান বিডি.টুনসম্যাগ.কম এক. শামীমা আজই প্রথম কিছু ভালো লাগা, কাউকে হাসতে দেখে মনের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি পেলো। অপূর্ব অ...
https://bd.toonsmag.com/2014/11/blog-post_4.html
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
এক.
শামীমা আজই প্রথম কিছু ভালো লাগা, কাউকে হাসতে দেখে মনের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি পেলো। অপূর্ব অনুভূতিগুলো বহুবার তার কাছে ধরা দিতে গিয়েও দেয়নি, পেয়েও বহুবার পায়নি সে। প্রাপ্তির শেষ পাতায় আজ তাই বড় বড় অক্ষরে লিখতে বসে সে। নিজস্ব একটা ডায়েরি আছে তার সবুজ রঙের। অযাচিতভাবে এর পাতাগুলোতে সবুজ রঙে ছেয়ে আছে। আদনান আমাকে ভালোবাসি কথাটা বলে দিয়েছে। ডায়রিতে লিখতে শুরু করলো সে। আর ক’ লাইন লিখতেই কানের কাছে এক ঝলক উষ্ণ হাসিতে চমকে উঠে শামীমা। মাথা না ঘুরিয়েই বুঝতে পারে বড় ভাবী তার পেছনে দাঁড়িয়ে প্রথম প্রেমের অনুভূতিগুলো পড়ছেন। ভাবীর কাছে নিতান্তই গোপনীয় ব্যাপারটা সংগোপনে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলো সে। পারেনি। ভেবেছিলো ভাবী এই দুপুর রাতে গভীর ঘুমে ভেসে আছেন তার নিজস্ব জগতে। তাইতো আস্তে করে উঠে টেবিলের ল্যাম্পটা জ্বেলে দিয়ে চুপিচুপি লিখতে বসলো সে। কিন্তু ত্রিকালদর্শিনী ভাবী যেনো সবই আগে ভাগে জেনে গিয়েছেন, নয়তো এই মাঝরাতে বড়জোর দু’ চারটি দুঃস্বপ্ন দেখতেন তিনি।
মিনিট দেড়েক ভাবীর হাসি কানে বাজতে থাকে শামীমার। ভাবীর মাঝরাতের হাসি থামে এক সময়। মুখ গম্ভীর করে কাঠখোট্টা গলায় বলেন, ছেলেটা দেখতে কেমন? ভাবীর প্রশ্নে ভ্যাবচ্যাকা খায় শামীমা। ভাবী বকাঝকা করে সাড়া পাড়াকে ভর দুপুর বানিয়ে ফেলবেন এমনটাই ভেবেছিলো সে। মা বেঁচে থাকলে যে তাই করতেন তা ভালো করেই জানে শামীমা। ভাবীর ব্যবহারে তাই একুল-ওকুল ভেবে ঠাঁই পায় না সে। এইতো সকালে নাস্তা বানাতে গিয়ে রুটিতে লবণ দিতে ভুলে গিয়েছিলো শামীমা। ভাবী তুচ্ছ ব্যাপারটাকে অনেক জোরে সোরেই ঘটা করে জানিয়ে দিয়েছেন আশেপাশের সবাইকে। গলা চড়িয়ে বলেছেন, কলেজে পড়ে অথচ এ মেয়ে রুটি বানাতে শেখেনি। পাশের বাসার নুরজাহান ভাবী আসাতেই অল্পতে রক্ষা শামীমার। নয়তো ভাবী কি যে কি বলে ফেলতো তাই ভেবে পেতো না সে। ভাবীর অভ্যাসই এ রকম। সামান্য কোনো ব্যাপারে শামীমাকে বকাঝকা করা চাই তার। প্রতিদিন হুলস্থুল না করলে যেনো দিনটাই ভালো যায় না তার। প্রথম প্রথম ভাবীর কর্মকাণ্ডে মন খারাপ লাগতো তার, ইচ্ছে হতো গলায় দড়ি দিতে। কিন্তু যখন বুঝলো বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকেই চিরকালের চেনা সেই ভাবী বদলাতে শুরু করেছেন, এই ভেবে ভাবীর জন্য ঘৃণার পরিবর্তে সহানুভূতি জাগে। মনে পড়ে মা মারা যাবার পর ছেলেবেলা থেকেই ভাবীর কোলে পিঠে সে মানুষ। ভাইয়ের আদর সে পেয়েছে খুব কম। ভাই নিজেকে রাখতেন অফিসকেন্দ্রিক। সকালে বের হয়ে ফিরতেন রাতে। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের দিন পেলো শামীমা। গোল্ডেন পাওয়ার খবরটা তাই জানা হলো না বড় ভাইয়ের। জানা হলো না শামীমা তার বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ করছে। তিনি বোনের আনন্দে উদ্ভাসিত হওয়ার ফুৎসুরত পেলেন না। তার আগেই যেতো হলো তার। শামীমা মাঝে মাঝে ভাবে, তার না গেলেই কি হতো না? বাইরের লোকেরা ভাবীকে যখন আধা পাগল বলে নিজের অজান্তেই কখন যে সে রেগে ওঠে তা টেরই পায় না শামীমা। নিজের ভেতরেই কুকড়ে থাকে সে।
জীবনের নানা জলিটতায় আচ্ছন্ন শামীমার পছন্দের জায়গা কলেজ ক্যাম্পাসের বকুল তলা। ঝাঁকে প্রেমিক যুগল, বন্ধুদের কথায় প্রাণবন্ত থাকে জায়গাটা। শামীমাও ক্লাস শেষে বন্ধুদের সাথে করে বসে পড়তো ক্যাম্পাস চত্বরে। পাঁচ মিশালী কথার তুবড়িতে যে কত আনন্দ পেয়েছে সে তা মনে পড়তেই অন্য রকম ভালো লাগে তার। আদনানের কাছে থাকতো সুর ছুইয়ে পড়া গান। সে গান শুনে বিমোহিত হয়ে যায় শামীমা। বাসায় ফিরে গানের কলিগুলো গুণগুনিয়ে গাইতো সে। ভাবীকে শুনাতো মাঝে মাঝে। মনে মনে ভাবতো আদনানকে কি কখনো সে নিজের করে পেতে পারে না? আদনান যখন সবার অনুরোধে গান ধরতো তখন নিষ্পলক চোখে তাকে পরখ করতো শামীমা। গায়কের উস্কোখুস্কো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হতো তার। তার হাত ধরে চষে বেড়াবে পুরো শহর, রেল লাইনের বাঁক, পার্কের এপাশ-ওপাশ। ভেবে ভেবে আগামীর স্বপ্নগুলো সাজিয়ে নিজের কাছে মেলে ধরতো সে। কত করে ভালো লাগাকে বুঝাতে চাইতো সে, বলতে চাইতো আদনান তুমি আমার হয়ে যাও, একান্তই আমার। কিন্তু বলা হয়নি কখনো।
আজ কলেজে গিয়ে বেশ অবাকই হতে হলো তাকে। কলেজ গেটে আদনান এক তোড়া ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শামীমাকে দেখেই অস্পষ্ট ভঙ্গিতে হাসলো সে, দুর্বলভাবে হাতছানি দিয়ে ডাকলো তাকে। কাছে যেতেই ফুলগুলো হাতে দিয়ে কিছু বলতে গিয়ে আদনান তোতলায়। কানের লতিটা লাল হয়ে উঠে। তারপর আচমকাই বলে, আমি কি তোমার হাতটি ধরতে পারি? প্রাপ্তির আনন্দে শামীমার কথা ফুরিয়ে আসে। থমকে থাকে সময়। তারপর লজ্জিত শামীমা এক সময় নিজের হাতটা বাড়িয়ে দেয় আদনানের দিকে। দুজনেই বিস্ময়ে চেয়ে রয় চোখে চোখে। ধ্যানমগ্ন হলে তারা আর কলেজ গেটে দাঁড়ায় না। কদমতলায় এসে তাদের গন্তব্য শেষ হয়। ধপ করে দুজন বসে পড়ে সবুজ ঘাসের গালিচায়। কতদিনের না বলা কথার মালাগুলো পরম যতনে গেঁথে যায় দুজনে...। আদনানকে পেয়ে বিজয়ীর বেশে বাসায় ফিরছিলো শামীমা। মনে ফুরফুরে ভাব। ভাবীর সাধারণ কথাও হেসে গড়িয়ে পড়েছে সে। তার মনে হয়েছিলো কানায় কানায় পূর্ণ হলো তার ভৈরব একাকিত্বের জীবন।
সংসারের মধ্যে নিজের ডাইরিটা খুব প্রিয় শামীমার। কলেজ থেকে ফিরেই জীবনের নতুন অভিজ্ঞতা পাতায় পাতায় কখন লিখে সুখের জমানো কথা শেষ করবে তাই নিয়ে উশখুশে ছিলো সে। সে সুযোগ পেলো রাতে। বড় ভাবী ঘুমিয়ে যাবার পর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাবীর চোখের আড়াল হতে পারে না শামীমা। ছেলেটা দেখতে কেমন প্রশ্নের জবাবে তার বুক ধরফর করে, ফোস ফোস করে নিঃশ্বাস বেরিয়ে যায় সশব্দে। একটু সাহস করে শামীমা ঘাড় কাত করে বড় ভাবীর দিকে তাকায়। চোখে পড়ে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির ছোয়া মেখে কৌতুহলি চোখে তাকিয়ে আছে বড় ভাবী। ভাবী আবার তাগাদা দেয়, বললি না ছেলেটা কেমন? শামীমা শ্যামলা রঙের আদনানকে ভাবীর কাছে ইংরেজদের মতো ফর্সা বলে চালিয়ে দেয়। ননদের উপস্থাপনার ভঙ্গি দেখে ভাবী হাসেন। মুখ গম্ভীর ভাবটা মুহূর্তেই উদাত্ত হয়ে যায়। শামীমা মনে মনে ভাবে, কালই আদনানকে বাসায় এনে ভাবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে সে। ডাইরিটা বন্ধ করে কৃতজ্ঞতায় ভাবীকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবেগে কাঁপতে থাকে শামীমা। বিড় বিড় করে কি যে বলে সে, ভাবী বুঝতে না পেরে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এক সময় বিছানায় দেহ এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। কতগুলো স্বপ্ন এসে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে চাঁদের দিকে মুখ করে। দু-একটা পাখি ডানা জাপটিয়ে জানান দেয় রাত পোহাতে আর দেরি নেই।
দুই.
ঘুম থেকে উঠেই ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে শামীমা আঁতকে উঠে, সাড়ে নটা বেজে চলেছে, নাস্তা না করেই নীল শাড়িটা পরে কলেজের পথ ধরে সে। আদনান বকুলতলায় ততক্ষণে এসে পড়েছে ভাবে শামীমা। বড় ভাবী ঘুমাচ্ছিলো। জাগাতে গিয়ে দেখে কেমন জ্বর ভাব করে আছে ভাবীর শরীরটা। নিষ্পাপ দেহ বদনে তাকিয়ে ভাবীর প্রতি অদ্ভুত মায়া অনুভব করে শামীমা। তাই ভাবীকে ঘুমোতে দিয়ে কলেজে ছুটে সে। ভাবীকে বিকেলে ইদ্রিস ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাবে সে, একবার মনে সে ভাবনাটুকু নিজের অজান্তেই খেলে যায়।
কলেজে পৌঁছে দেখে আদনান অন্ধকার রঙা একটা পাঞ্জাবী পরে ঘাসের বুক আলো করে বসে আছে। দূর থেকে শামীমাকে দেখেই মিষ্টি করে হাসে সে। শামীমাও হেসে তার জবাব দেয়। তবু সে বকুলতলায় পৌঁছবার আগেই কোথা থেকে যেনো ফাস্ট ইয়ারের অদিতি এসে আদনানের পাশে বসে পড়ে। খপ করে আদনানের হাত ঝাকাতে ঝাকাতে সে কী যেনো বলে। শামীমা অদিতির কান্না ভরা চোখ দেখে থমকে দাঁড়ায়। এক সময় অদিতির কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পায় সে। আমি থাকতে শামীমাকে কেনো? বলেছিলে না, তুমি শুধু আমাকেই ভালোবাসো, আর কাউকেই নয়। তবে কাল কেনো শামীমার হাত ধরে হেঁটেছো? প্রশ্নের তুবড়িতে আদনানকে অসহায় মনে হয়। আড়চোখে সে একবার শামীমাকে দেখে। কাঁদছে শামীমা। হু হু করে কাঁদা। আদনানের কেমন যেনো খারাপ লাগে। শামীমা ক্লান্ত দেহ নিয়ে সদ্যজাত প্রেমের ভাঙ্গনে মচকে যায়। সারাদিন ডাকাতিয়ার পাড়ে বসে থেকে আকাশ পাতাল ভাবে সে। আদনানের প্রতি ঘৃণায় তার চোখ কেপে উঠে। গৌধুলী বেলা মিইয়ে না যেতে যেতেই বাসার পথে পা বাড়ায় সে। হাতের মুঠো করে সারাদিনের কষ্টকে টেনে নিয়ে চলে আশ্রয়ের খোঁজে। বাসায় গিয়ে বড় ভাবীকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদবে সে, ঠিক করে নেয় শামীমা। দ্বিতল বাসার কাছে পৌঁছতেই অবস্থা অন্ধকার ঢেকে থাকে পৃথিবী। রুমে দরজাটা হা করে খোলা, লাইটগুলো নেভানো দেখে শামীমার ভাবনাগুলো খেই হারায়। ভাবী এই সন্ধ্যায় কোথায় গেলো? প্রশ্নটা মনে আসতেই অবাক লাগে শামীমার। এ সময় তো ভাবী কখনো কোথাও যায় না, মনে হতেই চিন্তিত লাগে তাকে। সুইচ বোর্ড খুঁজে লাইটটা জ্বালিয়ে দেয় সে। ভাবীকে বিছানায় ঘুমোতে দেখে খানিকটা স্বস্তিবোধ করে ননদটি। এই সন্ধ্যায় কেনো শুয়ে আছো ভাবী? বলেই দক্ষিণে ছড়ানো ভাবীর ডান হাতে মৃদু টান মারে সে। ভাবীর হাতের পরশ পেতেই নির্বাক হয়ে থমকে থাকে শামীমা। তার কাছে মরা মানুষের মতো কেমন শীতল থমথমে লাগে সেই হাত। স্তব্ধ হয়ে মৃত ভাবীর পাশে বসে থাকে মেয়েটি। কোথাও দু-একটা শুকুনের ডাক শোনা যায়। হঠাৎই সে ডাকে অপ্রকৃতিস্থদের মতো চিৎকার করে কাঁদতে থাকে শামীমা। সে কান্না চার দেয়ালের মাঝে প্রতিধ্বনি তুলে বাইরের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকে দ্রুত।