একজন গায়ক ও একটি ছেড়া জুতা
বিডি.টুনসম্যাগ.কম আমার মরহুম দাদাজানের বড় বেশি খায়েশ ছিল আমারে বিমানের পাইলট বানাবেন বলে। আর এজন্য উনি নিজের জমানো টাকা দিয়ে মাত্র ...
https://bd.toonsmag.com/2014/10/blog-post_17.html
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
আমার মরহুম দাদাজানের বড় বেশি খায়েশ ছিল আমারে বিমানের পাইলট বানাবেন বলে। আর এজন্য উনি নিজের জমানো টাকা দিয়ে মাত্র ৭ বছর বয়সেই আমাকে একখান হিরো সাইকেল কিনে দিয়ছিলেন। কিন্তু যেদিন বিশেষ ইস্টাইলে সাইকেল ড্রাইভ করতে গিয়ে আমাদের পাড়ার করিম চাচার স্বাস্থ্যবান রাম ছাগল খানা কোন প্রকার আগাম বার্তা ছাড়াই সরাসরি আমার সাইকেলের চাকার নিচে চাপা পড়িয়া দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলো সেদিনই বুঝলাম আমার আর বিমানের পাইলট হওয়া লাগবে না। দু-দিন বন্ধু নজরুলদের গরু ঘরের পেছনে (আমাদের শৈশবব কালের বিশেষ গোপন আস্তানায়) লুকিয়ে থাকার পর যখন ভীরু ভীরু মনে বাড়িতে আসলাম তখন দেখলাম বাড়ির উঠানের এক কোনায় আমার অতি আদরের দাদাজান আমার সাইকেল খানা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছেন। পরে বড় ফুপুর কাছে শুনলাম করিম চাচা নাকি দাদার কাছ থেকে ছাগলের জরিমানা বাবদ ১৫০০ টাকা নিয়েছেন। তাই একদিকে দাদার স্বপ্নভঙ্গ আর অন্যদিকে জরিমানা এই দুইয়ে মিলিয়ে দাদার মাথা মেজবাদের বাড়ির বড় চুলার আগুনের মত ১০০-১০০ গরম হয়ে গিয়েছিল আর রাগে আমার সাধের সাইকেলখানা কে কুপিয়ে এই অবস্থা করেছেন। যা হোক এরপর থেকে দাদা আমাকে নিয়ে আর স্বপ্ন দেখেননি। আর আমিও দাদার স্বপ্ন সত্যি করার পরিবর্তে নিজেই নিজের স্বপ্ন পূরণে নেমে গেলাম।
তখন টিভিতে গান শেখানোর একটা অনুষ্ঠান দিত। দেখতাম শিক্ষক সা...রে...গা...মা...পা...দা ...নি...সা.....আওয়াজ করে কি সুন্দর গান শিখাচ্ছে। আর আমিও তো বেশ সুন্দর করেই বলতে পারি...সারে...রে....গা....মা....পা..দা...নিসা....নিজে নিজে কয়েক বার গেয়েও দেখলাম। আহা!! আমার কাছে নিজের কন্ঠ বেশ ভালোই মনে হচ্ছিল। টিভিতে তখন মমতাজ .মনির খান, বেবী নাজনীন, আসিফরা গান গাইতো আর আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। ভাবলাম আমাকেও এদের মত শিল্পী হতে হবে সবাই আমার গান শুনে মুগ্ধ হবে, টিভিতে আমার ছবি দেখা যাবে, রেডিও তে আমার গান শোনা যাবে। ইশ! ভাবতেই মনের ভিতর একটা আনন্দের ঝিলিক এসে গেল। সেদিনই হিন্দু পাড়ার রতন কাকুর কাছ থেকে ২০০ টাকা দিয়ে একটা হারমানিয়াম আর একটা তবলা মাস খানেকের জন্য ভাড়া নিয়ে আসলাম। পরদিন বিকালে বন্ধু জাবেদকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কাচারি ঘরে গানের রেওয়াজে বসে গেলাম। জাবেদ তবলা বাজাচ্ছে আর আমি হারমোনিয়ামে বিচিত্র সব সুর তুলে উচ্চ স্বরে গান গাইছি 'আমার গানের মালা আমি করবো কারে দান......কারে দান করিতাম..।" একটু পরেই আমার আব্বা জানের চিৎকার শুনে বাইরে তাকিয়ে দেখি আমাদের গোয়াল ঘর থেকে কালো বলদটি দড়ি ছিড়ে দৌড়াচ্ছে। বুঝলাম আমার অতি সুরেলা কন্ঠের ঝংকারে ভয় পেয়ে কিংবা গানের মালা গ্রহন করার ভয়ে বলদটি দড়ি ছিড়ে পালিয়েছে। এরপর আমার মেজাজী আব্বাজান বাড়িতে আমার গানের উপর ১৪৪ ধারা জারি করলেন। কিন্তু আমি তো এত সহজে থেমে যাবার পাত্র নয়। আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাশ বাগানের নিরিবিলি জায়গাটা টাকে গান শেখার জন্য বেছে নিলাম। এখানেই নতুন করে গানের রেওয়াজ চলতে লাগলো। কিন্তু পরদিন গিয়ে দেখি বাশ বাগানে আমাদের গান রেওয়াজ করার সেই পবিত্র জায়গায় কারা যেন হাগিয়া.... দিয়াছে। মনে ভীষন কষ্ট পেলাম আবার এই ভেবে সান্ত্বনা পেলাম যে, জীবনে বড় শিল্পী হতে গেলে অনেক বাধা-বিঘ্ন কিংবা র্দূগন্ধ আসবে এগুলো নিরবে সহ্য করতে হবে। তবে একথা সত্য যে, এদের হাগু তে এত র্দূগন্ধ ছিল যে এগুলো ছিল সত্যিই সহ্য করার বাইরে। তাই বাধ্য হয়ে এগুলো পরিস্কার করতে হলো।
আমি শিল্পী মানুষ , হাগু পরিস্কার করা আমার জন্য ঠিক হবে না। তাই বন্ধু জাবেদ কে দিয়েই মলগুলো নিরাপদ দূরত্বে ফেলে আসলাম। অবশ্য এজন্য জাবেদকে বিকালে হোটেলে দুটো ডিম ভাজা আর ৬ টা পরোটা পারিশ্রমিক হিসাবে একস্ট্রা খাওয়াতে হয়েছে। কিন্তু পর পর তিনদিন যখন একই ভাবে আমাদের রেওয়াজ খানায় হাগু.... দেখতে পেলাম তখন বুঝলাম বাশ বাগানের এই জায়গাটাকে এলাকার গুটি কয়েক ব্যক্তি নিজেদের প্রাইভেট টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করছে। সুতরাং আর যাই হোক বাশ বাগানের এই পাবলিক টয়লেটে গান শেখা যাবে না। নুতন করে জায়গা খুজতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম। এলাকার আলতা সুন্দরী মিস শিউলি বিনতে নাফসি খাতুন দের বাড়ির পাশে বিশাল বটবৃক্ষের নিচে ছায়াঘেরা জায়গাটাই হবে আমাদের গান শেখার নতুন রেওয়াজ খানা। আর এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। গানে গান শেখা হবে আর আমার সুরেলা কন্ঠে মুগ্ধ হয়ে শিউলির সাথে আমার একটা কিছু হয়ে যাবে। এই আশায় বট বৃক্ষের নিচে প্রতিদিন বিকালে নিয়মমতো আবারও আমাদের রেওয়াজ চলতে লাগলো। কিন্তু দীর্ঘ এক সপ্তাহ ধরে প্রেমের গান, রোমান্টিক গান আমার কন্ঠে ঝড় তুললেও শিউলি একবারও আমার দিকে ফিরে তাকায়নি বরং তাদের বাড়ির কুকুর গুলো প্রতিদিনই আমাদের রেওয়াজের সময় ঘেউ...ঘেউ....করে সাড়া দিত। আফসুস.......শিউলি না বুঝলেও ওদের বাড়ির কুকুর কিন্তু ঠিকই আমার মায়াবী কন্ঠের জাদুটা ধরতে পেরেছিল। শেষমেষ শিউলির আশা ছেড়ে দিয়ে শিল্পী হওয়ার বাসনায় মনেপ্রাণে প্রতিদিন রেওয়াজ চালিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে আমার কন্ঠে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করলাম। অবশ্য এটা কেবল জাবেদের চোখেই ধরা পড়েছিল । জাবেদ বেশ উৎসাহ নিয়েই বললা- "দোস্ত তোর গলায় তো দারুন সুর চলে এসেছে। এখন শুধু গান গাইলে হবে না গানের সাথে নাচতেও হবে। দেখিস না টিভির মধ্যে মাইকেল জ্যাকসন গানের সাথে হাতেপায়ে কেমন তাল দিয়া নাচে। তোরে তো নাচও শিখতে হইবো।"
আসলেই তো কথা ঠিক। শুধু গাইলে হবে না গানের সাথে নাচতেও হবে। রাতে সিডিতে মাইকেল জ্যাকসনের বেশ কিছু নাচ দেখে নাচের খানিকটা কৌশল আয়ত্ব করলাম। বিকালে সেই কৌশল প্র্যাকটিক্যালি প্রয়োগ করতে গিয়েই ঘটলো বিপত্তি। লুঙ্গি পড়ে মাইকেল জ্যাকসনের মতো নাচতে গিয়ে আমার দীঘদিনের অতি আরামের লুঙ্গি খানা ছিড়ে গেল। অবশ্য পেছনে থেকে জাবেদ উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে- "আরে দোস্ত, বড় গায়ক হতে গেলে এরকম দু-চারটা লুঙ্গি কোরবানী দিতে হয়। তোর ৬ বছরের পুরনো এই লুঙ্গি তো কিছুই না।"
কিন্তু পর পর তিনদিন আমার তিনটা লুঙ্গি ছিড়ে যাওয়ার পর যখন চুরি করে পড়া বড় ভাইয়ার লুঙ্গিটাও ছিড়ে গেল তখন আমার আব্বাজানের আর দাদাজানের লুঙ্গিটাও ছিড়ুক সেই রিস্ক নিতে চাইনি। তাই গভীর রাত পর্যন্ত ভেবে দেখলাম মাইকেল জ্যাকসনের নাচ শিখতে হলে আমাকে আপাতত হাফপ্যান্ট পড়েই নাচতে হবে। যেইভাবা সেই কাজ পরদিনই ছোট ভাইয়ের হাফপ্যান্টটি পড়ে বেশ আরামেই নাচতে লাগলাম। এভাবে মোটামুটি কয়েক দিনের প্র্যাকটিসে জ্যাকসনের বেশ কিছু নাচ আমার আয়ত্ব চলে এল।
এদিকে বছরের শুরুতে আমাদের স্কুলে নবীন বরণ অনুষ্ঠান। জাবেদ বললো-দোস্ত এই সুযোগ তোর প্রতিভা প্রমাণ করার। যেভাবেই হোক তোকে নবীণ বরণ অনুষ্ঠানে একটা ফাটাফাটি গান আর নাচ দিতেই হবে।
আমিও ভাবলাম নবীন বরণে গান না গাইলে কিংবা না নাচলে স্কুলের ছেলে-মেয়েরা আর এলাকার মানুষ বুঝতেই পারবে না- আমি যে বড় গায়ক হতে চলেছি। আসলেই তো এটাই সুযোগ।
নবীণ বরণ অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা শ্রদ্বেয় নাঈম স্যার কে দিয়ে একটা গান গাওয়ারও ব্যবস্থা করে নিলাম।
শনিবার সকালে নবীন বরণ অনুষ্ঠান। তাই শুক্রবার বিকালে আমি আর জাবেদ ভাবতে লাগলাম কি গান গাওয়া যায়। কোন গানটা গাইলে হিট হবে,ফাটাফাটি হবে আর গানের সাথে নাচাও যাবে। শেষমেষ ঠিক করলাম মমতাজ আপার "ফাইট্টা যায়" গানটিই আমি গাইবো। কেননা গানটি তখন বেশ জনপ্রিয় ছিল আর গানের সঙ্গে ইচ্চেমতো নাচাও যাবে। এদিকে আমার আবার ভাল কোন জিন্সপ্যান্ট নাই আর জিন্সপ্যান্ট ছাড়া তো স্টেইজে জ্যাকসনের নাচ নাচাই যাবে না। সন্ধ্যায় পাড়ার এক লন্ড্রী থেকে ২০ টাকা দিয়ে একদিনের জন্য একটা জিন্সপ্যান্ট ভাড়া নিলাম। বাড়িতে এনে পড়ে দেখলামপ্যান্ট-টা বেশ টাইট হয়েছে। তাই ভিতরে অন্য কোন শর্টপ্যান্ট পড়া ছাড়াই কোনমতে জিন্সপ্যান্ট-টি পড়ে মনে বেশ আনন্দে নিয়ে চেহারা সুরতে ব্যাপক রং ফর্সাকারী ক্রিম আর পাউডার মেখে বিস্তর ইস্টাইল করে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
সকাল ১০ টায় নবীন বরণ অনুষ্ঠান শুরু হলো। কয়েকটি গান আর কৌতুকের পর মাইকে আমার নাম ভেসে এলো। স্টেইজে উঠে দেখালাম চারপাশে অনেক দর্শক। মনে মনে ভাবলাম সত্যিই আজকে ফাটিয়ে দেবো। মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই শুরু করলাম- "ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায় ...আমার বন্ধু যখন বউ নিয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায়....ফাইট্টা যায়.....বুকটা ফাইট্টা যায়...." এভাবে কয়েক কলি গাওয়ার পর যখন মাইকেল জ্যাকসনের পায়ের নাচটা দিতে গেলাম তখনই বুঝলাম সত্যি সত্যি ফাইট্টা গেছে.....বিকট শব্দে আমার জিন্সপ্যান্ট পেছনে পশ্চাৎদেশে ফাইট্টা গেছে.....আর এ অবস্থায় ভিতরে ইজ্জত রক্ষার কোন শেষ সম্ভল না থাকায় আমি গান আর নাচ বন্ধ করে স্টেইজের পেছনের কাপড়ের সাথে দাড়িয়ে আমার প্যান্ট পিছনের ছেড়া অংশ লুকিয়ে রেখে দাড়িয়ে রইলাম। আর নিজের মনকে বোঝাতে লাগলাম- জাহাঙ্গীর, গায়ক না হলে হয়তো তুই শিক্ষক, চিকিৎসক, চাকরীজীবি কিংবা ব্যবসায়ী হবি কিন্তু একবার ইজ্জত গেলে আর ইজ্জত পাবি না।
এদিকে আমার এ অবস্থা দেখে উত্তেজিত দর্শকদের মধ্য থেকে কেউ জুতা, কেউ স্যান্ডেল,কেউ পচা টমেটা আবার কেউ কেউ পচা ডিম ছুড়ে মারলো......
তবে আফসুস একটাই- তোরা মারবি যখন একই পায়ের একজোড়া ভালো জুতা মারতি.....অন্তত সেটাই হতো আমার গায়ক জীবনের প্রথম স্টেইজ শো তে পাওয়া চির স্বরণীয় অমর উপহার।