রূপময় বাংলার মুগ্ধ চিত্রকর বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরী

আহমদ রফিক কীএমন জরুরি কথা যে, কথা শেষের পরও আবার ফিরে আসতে হয় মাইকে। কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই প্রিয় জীবনের কাছ থেকে আকস্মিক বিদায় নেয়...

আহমদ রফিক
কীএমন জরুরি কথা যে, কথা শেষের পরও আবার ফিরে আসতে হয় মাইকে। কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই প্রিয় জীবনের কাছ থেকে আকস্মিক বিদায় নেয়া। স্বনামখ্যাত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যু শিল্পসংস্কৃতি ভুবনে প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেল। যে প্রশ্নের কখনও মীমাংসা হবে না। চলতে পারে শুধু অনুমান আর কল্পনা, তার 'কী কথা ছিল বলার।'

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আসর (আয়োজকদের ভাষায় সম্মেলন) ঢাকার সামরিক স্টেডিয়ামে, ৩০ নভেম্বর। যেমন আয়োজনে সমারোহ তেমনি সেই অভিজাত অকুস্থলে অভিজাত দর্শক-শ্রোতার সমাগম। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তা বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। শোকাবহ ঘটনার আকস্মিকতার কারণে কিনা জানি না, সংবাদদাতাদের প্রতিবেদনে কাইয়ুম চৌধুরীর প্রদত্ত বক্তৃতা-বক্তব্য উঠে আসেনি। একই বাক্যের পুনরাবৃত্তি- 'শেষ কথা হলো না বলা'।

সংবাদ মাধ্যমে পরিবেশিত তার সংক্ষিপ্ত জীবনীতে কাগজ থেকে কাগজে শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন স্থানের উল্লেখ আছে; কিন্তু উল্লেখ নেই চিত্রাতীরের শহরটির যেখানে তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা এবং বয়সে বছর তিনেকের ছোট হলেও কাইয়ুম এবং প্রধানত তার বড় ভাই কাদের আমার শৈশব-কৈশোরের খেলার সাথী। আমার ধারণা, জনস্রোতের সান্নিধ্যে, গাছগাছালির সবুজে স্নিগ্ধ শহরের প্রকৃত রূপ তাকে মুগ্ধ করেছিল।

এরপর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দীর্ঘকাল পর ঢাকায় এসে। তখন কথাচ্ছলে জানা গেছে, তার নড়াইল-প্রীতির কথা। আসলে সেটা ছিল গ্রাম-বাংলার গ্রামীণ প্রকৃতি ও লোকায়ত-জীবন সম্পর্কে কাইয়ুমের মুগ্ধতার একটি ছোট্ট কালখন্ড। শচীনকর্তার পল্লীগীতি আর আব্বাস উদ্দীনের লোকগীতির সবুজ-শ্যামল-সজল বাংলা, তার লোকায়ত-ঐতিহ্য কাইয়ুম চৌধুরীর শৈশব-কৈশোরের শিল্পীমনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। পরবর্তী সময়ের আধুনিকতার শহরজীবন-নগরজীবন, তা মুছে ফেলতে পারেনি। এমন একটি সাংস্কৃতিক-সামাজিক-শৈল্পিক ভিত্তিভূমিতে চিত্রকলার ছাত্র এবং সেই শিল্পের সাধক হিসেবে কাইয়ুম চৌধুরীর নান্দনিক বিকাশ।

লক্ষ্য করার বিষয়, ১৯৪৯-এ ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ঢাকায় আর্টস স্কুলে তার ভর্তি। পঞ্চাশের দশকে শিক্ষা ও সংস্কৃতি অঙ্গনে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল রাজনৈতিক প্রগতিশীলতার প্রাধান্য। যেমন আর্টস স্কুলে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশে, তেমনি মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এবং অংশত ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজে। বাদ যায়নি মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলও। প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে প্রগতিবাদের যেন বিপরীত স্রোতে অবগাহন।

সংখ্যালঘু হয়েও চেতনার সমৃদ্ধিতে এরা সংখ্যাগুরু। আর্টস স্কুলের কথাই যদি ধরি তাহলে আবেদিন স্যারের প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে প্রগতিবাদী ধারায় আমিনুল, দেবদাস, বিজন চৌধুরী, বশির, ইমদাদ, সবুর, কাইয়ুম প্রমুখ একগুচ্ছ নাম। তেমনি ফজলুল হক হল, ঢাকা হলে আনোয়ার, গাজিউল, আতীকুল্লা, রফিকুল, মশারফ হাসান, মৃণাল, দেবপ্রিয়, আফসার, কমরুদ্দীন একই সময়ের প্রগতিবাদী রাজনৈতিক চেতনার শিক্ষার্থী। সঙ্গে আরও অনেকে।

বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন আমাদের এ ছাত্রমহলের জন্য আশীর্বাদরূপে এসেছিল। বাঁকফেরা পরিবর্তন ঘটিয়েছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্প ও রাজনৈতিক অঙ্গনে। পূর্বোক্ত ছাত্র গ্রুপের পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ ও জগন্নাথ কলেজও ছিল তরুণদের প্রগতিশীল মোর্চা। যেমন এদের সবাই তেমনি এদের মধ্যে কিছুটা অন্তর্মুখী কাইয়ুম চৌধুরী প্রগতি রাজনীতির আদর্শে বাধা পড়েছিল, প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতিতে নয়। এ আদর্শিক ভাবনা জীবনভর বহন করেছেন কাইয়ুম।

দুই

কাইয়ুম চৌধুরী চিত্ররীতির একাধিক মাধ্যম ব্যবহারে যেমন দক্ষ চিত্রশিল্পী, তেমনি একইভাবে প্রতিভাবান প্রচ্ছদশিল্পী। সত্যি বলতে কী, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, এমনকি পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধ্বেও পূর্ববঙ্গে প্রচ্ছদ অঙ্কনে উচ্চমান বা অভিনবত্বের প্রকাশ ততটা ছিল না, যতটা আধুনিক মন বা আধুনিক মনন দাবি করতে পারে। তখনকার প্রচ্ছদগুলোর দিকে তাকালে আমার বক্তব্যের তাৎপর্য স্পষ্ট হবে।

একজন নামি শিল্পীর অাঁকা 'শিল্প সংস্কৃতি জীবন' বইটির দিকে তাকিয়ে তখনও ভেবেছি, এখনও ভাবি- হায় একি সমাপন! বিরাজমান এ বৃদ্ধাবস্থায় প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে কাইয়ুম চৌধুরী বাঁধভাঙা অভিনবত্বের প্রকাশ ঘটান। যেমন রেখার তির্যকতায়ও, কখনও রঙের বাহারে, কখনও আঙ্গিকের অভিনবত্বে। স্বভাবত নয়া ঘরানার প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে কাইয়ুম চৌধুরীর সুনাম, বলতে হয় খ্যাতি সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে।

তার অঙ্কন বৈশিষ্ট্যে যেমন চোখে পড়বে রেখার নম্র মাধুর্য, তেমনি আবার কোমল রঙের সুষমা, কখনও নিছক বর্ণমালার বিচিত্র অবস্থান ও সেইসঙ্গে রেখার অাঁকিবুঁকিতে। একেকটি প্রচ্ছদ যেন ছোট একেকটি শিল্পকর্ম। আমি এখনও ভুলতে পারি না, ষাটের দশকে আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'বাউল মাটিতে মন'-এর অসামান্য প্রচ্ছদটি। সেই কবে এর বিনম্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়েছিলাম, বর্তমান দশকে এর নতুন সংস্করণে সেই প্রচ্ছদচিত্রটি দেখে আধুনিক চেতনার তরুণ ও যুবাদের মধ্যেও দেখতে পাই একই ধরনের মুগ্ধতা।

এ ধরনের একাধিক কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদচিত্রে রয়েছে কাইয়ুম চৌধুরীর অসামান্যতার স্বাক্ষর। যেমন রেখাচিত্রে, তেমনি রঙের চিত্রকল্পে। শুধু আমার বলে নয়, বিভিন্ন লেখকের বহুসংখ্যক বইয়ে কাইয়ুম চৌধুরীর অাঁকা প্রচ্ছদচিত্র দেখেছি। আর মুগ্ধ হয়েছি সেগুলোর পরস্পর থেকে ভিন্ন বৈচিত্র্যে। এ বৈচিত্র্যের মধ্যেই শিল্পবোদ্ধা খুঁজে পাবেন কাইয়ুম চৌধুরীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের চিহ্নগুলো, যা নিঃসন্দেহে এই নির্দিষ্ট চিত্রশিল্পীকে চিনিয়ে দেয়।

আমি যতদূর জানি, কাইয়ুম চৌধুরী শিক্ষায়তনে 'ফাইন আর্টস'-এর ছাত্র হয়েও তার জীবনের বড় একটি সময় প্রচ্ছদশিল্প এবং পত্রিকা ও পুস্তক অলঙ্করণের পেছনে কাটিয়ে দিলেন। অথচ তার নিজস্ব ধারায় শিল্পকর্মে সময় ও শ্রম দিলে তার কোনো কোনো সতীর্থের মতো ওই বিশেষ শাখায় যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করতে পারতেন। অর্থাৎ খ্যাতি যা পেয়েছেন তারচেয়ে অনেক বেশি। তবুও কেন একই ধারায় তার শ্রম ও কালক্ষেপণ।

তার সঙ্গে আলাপে যা বুঝেছি তা হলো, শিল্প সৃষ্টির এ শাখাটিকে, তা সে যত ব্রাত্যই হোক না কেন, শিল্পমানে টেনে উপরে তোলা, একে উৎকর্ষের একটি বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে দেয়াই ছিল শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর উদ্দেশ্য। সে কাজটি এক হাতে, একাই অনেকখানি সম্পন্ন করেন কাইয়ুম। তার সৃষ্ট ধারার ধারাবাহিকতা পরবর্তী পর্যায়ে অনেক দক্ষ প্রচ্ছদশিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছে, এখন তারা অনেকেই স্বনামখ্যাত।

কিন্তু এর মধ্যে গত দুই-আড়াই দশকেও এ বিশেষ শাখায় কাইয়ুম চৌধুরী এখনও অনন্য। এখনও প্রকাশনা ভুবনে শিখরচুম্বী সৃৃষ্টির জন্য অনেককে তার দ্বারস্থ হতে দেখেছি। আন্তর্জাতিক ঘরানার শিল্পকর্মে, কী সরকারি, কী বেসরকারি খাতে উৎকর্ষের সোনালি অাঁকের জন্য ডাক পড়ে কাইয়ুম চৌধুরীর। হাজার কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তাকে সাড়া দিতে হতো, না দিয়ে পারেননি কাইয়ুম। এটাও তার এক ধরনের 'অবসেশন'।

সবশেষে একটি কথা বলতে হয়। তার শিল্পকর্মের প্রাকরণিক চরিত্র বিচারে, বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে তার কোনো কোনো সহপাঠী শিল্পীর মতো পাশ্চাত্য শিল্পকলার প্রভাব বা আত্তীকরণ কতটা- তা নিয়ে ভাবতে গেলে আমি অন্তত নিশ্চিত, তার হাতের জাদুতে রূপসী বাংলা, লোকায়ত বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প আঙ্গিকেরই প্রাধান্য, যেখানে বাংলার আকাশ, মাটি, পুষ্পিত শস্যক্ষেত্র ও উদ্ভিদ জগৎ, সেইসঙ্গে ছুটে চলা জলস্রোতের রূপময় দৃশ্য, যা দিন-রাতের প্রহরে প্রহরে নানা চরিত্রে প্রকাশ পায়।

কাইয়ুম চৌধুরীই এ রূপময়তার মুগ্ধ চিত্রকর, তা সে প্রচ্ছদশিল্পে হোক বা হোক তার জলরঙের বা তেলরঙের কলারীতির কারুকর্মে। এসব কারুকর্মে এবং প্রচ্ছদশিল্পের অভিনব ঘরানায় বেঁচে থাকবেন চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। থাকবেন একজন জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমী হিসেবে, যার সঙ্গে প্রগতির কোনো বিরোধ নেই।

আহমদ রফিক

ভাষা সংগ্রামী, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

- See more

এই বিভাগে আরো আছে

চিত্র শিল্পী 3794366138348153967

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সঙ্গে থাকুন

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক

বৈশিষ্ট্যযুক্ত

বিশ্বসেরা ১০ কার্টুনিস্ট

শিল্পী রফিকুননবী সাধারণ মানুষের কাছে যতটা না তার ফাইন আর্টসের জন্য পরিচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় তার ‘টোকাই’ কার্টুন চরিত্রের জন্য। এ ...

-

  • ফেসবুকে অনুসরণ করুন

    আঁকা-আঁকি আহ্ববান

    আপনার আঁকা, মজার মজার লেখা, ছবি আঁকার কলা-কৌশল, শিল্পীর জীবনী, প্রবন্ধ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অথবা প্রদর্শনীর সংবাদ টুনস ম্যাগে ছাপাতে চাইলে পাঠিয়ে দিন। আমাদের ইমেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।

    সহায়তা করুন

    item