উৎলার পাড়ের পোড়া পাহাড় আর বুদ বুদ কূপ

আলমগীর হোসেন  বিডি.টুনসম্যাগ.কম বন-পাহাড়ে ঘেরা জলের মঞ্চে আগুনের উৎসব। পোড়া পাহাড়ের বুকে অগনিত আগুনের চুল্লি থেকে সাপের মতো জিহবা নাড়ছে লেলি...

আলমগীর হোসেন 
বিডি.টুনসম্যাগ.কম

বন-পাহাড়ে ঘেরা জলের মঞ্চে আগুনের উৎসব। পোড়া পাহাড়ের বুকে অগনিত আগুনের চুল্লি থেকে সাপের মতো জিহবা নাড়ছে লেলিহান আগুন। সব প্রাকৃতিক নিয়মকে তুড়ি মেরে এখানে চলছে প্রকৃতির নিয়ম ভাঙ্গার খেলা। সিলেটের পথে পথে বিছানো চমকিত সৌন্দর্যের ভিড়ে নিজেকে আলাদা করে যেন রহস্যপুরী হয়ে উঠেছে উৎলার পাড়। তাই তো রহস্যপিপাসু পর্যটকদের পদধ্বনিতে মুখরিত উৎলার পাড়ের পোড়ামাটির পথ।
আগুন-পানি চির শত্রু। অথচ ম্যাজিকের মতোই প্রকৃতির সব নিয়ম ভেঙ্গে উৎলার পাড়ের পানিতে আর পাহাড়ে অবিরাম জ্বলছে আগুন। উৎলা মানে বুদ বুদ। এই জলাশয়ে বুদ বুদ আর ফেনার ছড়াছড়ি। ভাসমান ফেনাতে দেয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে দিতেই ধপ করে করে জ্বলে ওঠে আগুন।

রহস্য কি! ইতিহাস আছে?

খালি চোখে উৎলার পাড় রহস্যময়। কিন্তু বিজ্ঞানের চোখে মামুলি। এখানকার মাটি গ্যাসে পূর্ণ। এটাই হচ্ছে হরিপুরের সেই জায়গা যেখানে বাংলাদেশের প্রথম গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়।

সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের পূর্বসূরী পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (পিপিএল) পরিচালিত গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের এক পর্যায়ে ১৯৫৫ সালে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরে ড্রিলিং কার্যক্রম শুরু হয়। এখানে কূপ নং-১ খননের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম গ্যস আবিষ্কৃত হয় । কিন্তু কূপটি ব্লো-আউট হয়ে গ্যাস উত্তোলনের সব উপকরণ মাটিতে দেবে যায়।

দেবে যাওয়া এ কূপে পরবর্তিতে জলাশয়ের সৃষ্টি হয় এবং গ্যাসের প্রচণ্ড চাপে বুদ বুদ উঠতে থাকে। অবিরাম এই বুদ বুদের ফলে  এলাকার নাম হয়ে যায় উৎলার পাড়। ১৯৫৬ সালে পুনরায় কূপ নং-২ খনন করলে সেখানেও গ্যাসের উচ্চ চাপের ফলে কূপটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।

২ নং কূপের কাছেই পোড়া পাহাড়।  যেখানে এক সময় দাউ দাউ করে সারা পাহাড়ে জ্বলত আগুন। সেই আগুন অনেক দূর থেকেও দেখা যেত অনায়াসে। এখন অবশ্য  খুব কাছে না গেলে দেখা যায় না।

হরিপুর-চিকনাগুল ভূ-খণ্ডে ১৯৫৭ সালে ৩ নং কূপসহ পরবর্তিতে আরো পাঁচটি কূপ খনন করা হয় । ১৯৬০ সাল থেকে সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেড নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস উৎপাদন করে আসছে। বর্তমানে উৎপাদনরত ২টি কূপ থেকে দৈনিক ৬০ কনডেনসেট (ব্যারেল) ৮.৫ গ্যস (এমএমএসসিএফ) উৎপাদন হচ্ছে।

স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে পিপিএল এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিপিএল নামে পরিচালিত কোম্পানিটি ১৯৮২ সালের ৮ মে থেকে সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেড (এসজিএফএল) নাম ধারণ করে।

১৯৮৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর এ ভূখণ্ডের ৭ নং কূপে দেশের সর্বপ্রথম খনিজ তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯৯৪ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত ৫.৬ লাখ ব্যারেল ক্রুড ওয়েল উৎপাদনের পর কূপের মুখে চাপ হ্রাস পাওয়ায় তেল উৎপাদন সম্পূর্ন বন্ধ হয়ে যায় ।


আছে আহমদ আলী শাহ’র মাজারঃ

উৎলার পাড় আর আহমদ আলী শাহ্’র ইতিহাসকে এক সূত্রে গাঁথেন স্থানীয়রা । এ নিয়ে স্থানীয়দের মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে নানান গল্প। স্থানীয়দের ভাষ্যে পিপিএলের নেতৃত্বে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বৃটেনের বার্মা ওয়েল কোম্পানি  যখন এখানে তাদের কার্যক্রম চালায়  তখন কোম্পানির লোকেরা রাতের অবসরে উচ্চস্বরে গান বাজনা করতো।

মাওলানা আহমদ আলী শাহ পাশেই এক পাহাড়ে (যেখানে এখন তাঁর মাজার রয়েছে) ইবাদত  করতেন। তাঁর ইবাদতে ব্যাঘাত ঘটলে তিনি কোম্পানির লোকদেরকে উচ্চস্বরে গানবাজনা করতে নিষেধ করেন। কিন্তু মাওলানাকে তারা পাগল বলে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। এতে  ক্ষিপ্ত হয়ে পাশেই এক পাহাড়ে তিনি হারিকেন জ্বালিয়ে দিলেন।

সে রাতেই হারিকেন থেকে আগুন সারা পাহাড়ে ছড়িয়ে আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয় যা এখনো জ্বলছে এবং কূপ খননের সব উপকরণ মাটির গহীনে দেবে গিয়ে জলাশয়ের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে হেলিকপ্টার দিয়ে জলাশয়ের গভীরতা মাপা হলেও এর কোনো কিনারা খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি ধ্বংস হওয়া যন্ত্রপাতির কোনো অস্থিত্বও।

কূপ-১, কূপ- ২ ও পোড়া পাহাড়কে আহমদ আলী শাহ্ এর অভিশাপের ফল বলে মনে করা হয়। উৎলার পাড়ে চির শায়িত আছেন মাওলানা আহমদ আলী শাহ্ । পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষণ উঁচু পাহাড়ে আহমদ আলী শাহ্ মাজার।


যেভাবে যাবেনঃ

সিলেট শহর থেকে হরিপুর, জৈন্তা, জাফলং গামী লেগুনা বা বাসে চড়ে এখানে যেতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল এলাকায় অবস্থিত সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের প্রধান শাখা হয়ে গাড়ি করে মাত্র এক-দেড় মিনিট পথ সমানে এগুলেই হরিপুর ৭ নম্বর এলাকা। এখানে নামলেই পর্যটকদের স্বাগত জানাবে আহমদ আলী শাহ’র মাজার গেইট। গেইট পেরিয়ে পাঁচ মিনিট সামনে হাঁটলেই চোখের পড়বে দিক নির্দেশনাকারি সাইনবোর্ড। এর বাম দিকে গেলে প্রথমেই দেখে নিতে পারবেন সেই বুদ বুদ কূপ এবং ডান দিকে গেলে পোড়া পাহাড় ও আহমদ আলী শাহ’র মাজার।

অবশ্য যে কোনো এক পথ দিয়ে ঢুকলেই সম্পূর্ণ দৃশ্য উপভোগ করে অন্য পথে বের হওয়া যাবে। হেঁটে বা গাড়ি করেও পুরো এলাকা ঘুরে দেখা যাবে। প্রায় প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে এসে এখানে ভিড় করে উৎসুক পর্যটক।

শতর্কতাঃ

যেহেতু আশপাশের বায়ূমণ্ডলে দাহ্য গ্যসের উপস্থিতি রয়েছে সেহেতু আগুন থেকে হতে হবে সতর্ক। পানিতে বা মাটিতে আগুন জ্বালানো উপভোগ করতে হবে সাবধানে।

এই বিভাগে আরো আছে

ভ্রমণ 4122764349784327418

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সঙ্গে থাকুন

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক

বৈশিষ্ট্যযুক্ত

বিশ্বসেরা ১০ কার্টুনিস্ট

শিল্পী রফিকুননবী সাধারণ মানুষের কাছে যতটা না তার ফাইন আর্টসের জন্য পরিচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় তার ‘টোকাই’ কার্টুন চরিত্রের জন্য। এ ...

-

  • ফেসবুকে অনুসরণ করুন

    আঁকা-আঁকি আহ্ববান

    আপনার আঁকা, মজার মজার লেখা, ছবি আঁকার কলা-কৌশল, শিল্পীর জীবনী, প্রবন্ধ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অথবা প্রদর্শনীর সংবাদ টুনস ম্যাগে ছাপাতে চাইলে পাঠিয়ে দিন। আমাদের ইমেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।

    সহায়তা করুন

    item