পরীক্ষা থেকে চারু ও কারুকলা বাদ দেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনকঃ হাশেম খান
পংকজ রায়, বিডি.টুনসম্যাগ.কম শিল্পকলা মানব মনকে তৃপ্ত করে নিয়ে যায় সুন্দর ও সত্যের পথে। মানুষের রুপ সৌন্দর্য বোধ দ্বারা অনুপ্রানিত মানস...
https://bd.toonsmag.com/2017/12/2589.html
শিল্পকলা মানব মনকে তৃপ্ত করে নিয়ে যায় সুন্দর ও সত্যের পথে। মানুষের রুপ সৌন্দর্য বোধ দ্বারা অনুপ্রানিত মানসিক ও কায়িক শ্রম নির্ভর সৃজনশীল কর্মই শিল্পকলা। শিল্পকলার যাত্রা আদিম মানুষের হত ধরে শুরু হলেও সভ্যতার বিবর্তনে আধুনিক বিশ্ব বিনির্মানে মানুষ আজও প্রয়োজন ও সৌন্দর্য বোধের তাগিদ থেকে শিল্পের নানা মাধ্যমের চর্চা অব্যাহত রেখেছে। পৃথিবী জুড়ে চলছে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিল্পকলার চর্চা। আর বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) শুরুটা ১৯৪৮ সালে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে প্রথম প্রজন্মের শিল্পীরা ঢাকায় গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট তথা চারু ও কারুকলা শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের শিল্পীদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় এদেশে চারু শিল্পের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৩/৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারী বেসরকারী ভাবে জেলা/বিভাগীয় শহর গুলোতে ছড়িয়ে আছে প্রায় ৮/১০টি আর্ট কলেজ। আর এসব আর্ট ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী/শিল্পিরাই সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে বাংলা শিল্প সংস্কৃতির ভান্ডার। দেশ-বিদেশের চিত্র শিল্প, ভাস্কর্য শিল্প, ক্যালিগ্রাফি শিল্প, পোষাক শিল্প, কার্টুন চিত্র শিল্প, বিজ্ঞাপন শিল্প, চলচিত্র শিল্প, মুদ্রণ শিল্প সহ প্রায় সব শিল্পের শাখা প্রাশাখায় দেশীয় চারু শিল্পিদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহন পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষা, শিল্প-সংস্কৃতি রক্ষা, বাঙ্গালির অধিকার আদায়ে চারু শিল্পিরা ছিল সামনের সারিতে, বিশ্ব শিল্পকলার জগতেও তাঁদের সমান বিচরন। এদেশের চারু শিল্পের উচ্চ শিক্ষার ভিত্তি অনেকটা সমৃদ্ধ হলেও স্কুল পর্যায়ে চারু ও কারুকলা শিক্ষা গল্পটা অন্যরকম। জানা যায়, স্বাধীনতা পরর্র্বতী সব শিক্ষা কমিশনের রির্পোটে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পযার্য়ে সৃজনশীল বিষয় চারু ও কারুকলা অর্ন্তভুক্ত থাকলেও কোন সরকার বিষয়টি সমাধান করতে পারেনি। আশার কথা হল বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের উদ্দেশ্যে এনসিটিবি কর্তৃক সর্বপ্রথম ২০১৩ সালে দেশের প্রায় ২০ হাজার বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ৫০ নম্বরের আব্যশিক বিষয় ও ৯ম-১০ম শ্রেণীতে ১০০ নম্বরের ঐচ্ছিক হিসেবে) চারু ও কারুকলা নামে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করে। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সব শ্রেণী পেশার সচেতন মানুষ সাধুবাদ জানায়। কিন্তু বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান জনবল কাঠামোয় উক্ত বিষয়টির অস্তিত্ব না থাকায় কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ ৪ বছর থেকে বই বিতরণ করলেও এ বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগে ব্যার্থ হয়। ফলে ভেঙ্গে পরে স্কুল পর্যার্য়ে চারু ও কারুকলা শিক্ষা ব্যবস্থা। অনুসন্ধানে জানা যায়, শহরের কিছু বিদ্যালয় নিজ তাগিদ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ দিলেও গ্রাম অঞ্চলের প্রতিষ্ঠান গুলো এ শিক্ষা প্রসারে পিছিয়ে পরে। ফলে দেশের সচেতন শিল্পী সমাজ, শিক্ষক, অভিভাবক ও কোমলমতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ছাপ স্পষ্ট হয়। এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থা কাটিয়ে ওঠার আগেই গত ২২ মার্চ (২০১৭) এনসিসিসি’র এক বৈঠকে অষ্টম শ্রেণির পাবলিক (জেএসসি) পরীক্ষা থেকে বোঝা কমানোর অজুহাতে বিষয়টি (চারু ও কারুকলা) বাদ দেওয়া হয়। এনসিসিসি’র এমন হটকারী সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয় শিল্প অঙ্গনের সব মানুষ। প্রতিবাদে নেমে পরে শীর্ষ পর্যায়ের চারু শিল্পীদের বিভিন্ন সংগঠন ও বিভিন্ন চারুশিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। রাজধানী ঢাকা সহ প্রতিবাদ মূখর হতে দেখা যায় বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ, চারুকলা শিক্ষক পরিষদ বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম চারুশিল্পী সম্মিলন পরিষদসহ অসংখ্য সংগঠনকে। সাম্প্রতিক সময়ের এমন পরিস্থিতিতে স্কুল পর্যায়ে চারু ও কারুকলা বিষয়টি পরীক্ষায় বাদ দেওয়া, উক্ত বিষয়ের শিক্ষক সংকট, এর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, কোমলমতী শিক্ষর্থীদের সৃজনী মেধা ও সৌন্দর্য বোধ বৃদ্ধিতে বিষয়টি গুরুত্বসহ নানা দিক নিয়ে কথা হয় শিল্প অঙ্গনের অনেকের সাথে। কথা হয় দেশের শীর্ষসারির ক’জন বরণ্যের চিত্র শিল্পীর সাথে। তাদের মধ্যে অন্যতম বহুমাত্রিক শিল্পী হাশেম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে চারু ও কারুকলা বিষয়ের (কারিকুলাম ও পাঠ্যসূচি) প্রনয়নকারী, শিল্পী হাশেম খান বলেন, “আমি সবই (কারিকুলাম, পাঠ্যসূচি প্রনয়ন ও অলংকরণ) করে দিয়েছি। উদ্দেশ্য ছিল ছেলে মেয়েরা এ শিক্ষা লাভের মাধ্যমে শৈল্পিক মন নিয়ে বেড়ে উঠবে। জেএসসি পরীক্ষায় বিষয়টি বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন এটা আমার জন্য অত্যন্ত দূঃখ জনক। সরকার কেন এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়। সরকারের এ হটকারী সিদ্ধান্তের বিপক্ষ্যেমত দেন তিনি। তিনি আরো বলেন, বিষয়টি নিয়ে খুব চিন্তিত আছি। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সাবেক পরিচালক, কার্টুনিষ্ট ও বিশিষ্ট শিল্পী রফিকুন নবী (রনবী) স্কুল পর্যায়ে চারু ও কারুকলা শিক্ষার গুরুত্বারোপ করে তিনি জানান, শিশুরা বড় হবে মুক্ত ভাবে, তারা বড় হবে সৃষ্টিশীল চিন্তার মধ্যদিয়ে। শিল্পকলা চর্চার মাধ্যমে তাদের মনে একটা রুচিবোধ সৃষ্টি হবে যা তার পরবর্তী জীবনের শিক্ষায় কাজে লাগবে। তিনি অনেকটা গর্বের সাথে আরো বলেন, আমাদের দেশের শিশুরা এ শিক্ষার তেমন জ্ঞান না নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করছে। তারা কিন্তু পুরুস্কার অর্জনের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে দেশের ভাব মূর্তি উজ্জল করছে সে খবর ক’জন রাখে? তাঁর মতে, এসব বাচ্চারা যদি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করে তাহলে তারা আরো কত দূর যাবে, এটা কেউ ভাবে? স্কুলে চারু শিল্প শিক্ষার গুরুত্ব বর্ণনায় তিনি আরো যোগ করেন যে, ছেলে মেয়েরা এটা শিখবে নূন্যতম ধারনা লাভ করবে, তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে বড় হবে। এদের মধ্যে কেউ যদি এ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা নিতে চায় তাদের জন্য অনেক সুবিধা হবে। আবার বিদ্যালয় গুলোতে যদি উক্ত বিষয়ের শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা যায় তবে উচ্চ শিক্ষা শেষে অনেকেই শিক্ষকতায় আসতে পারবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষটি কেন বারবার অবহেলিত হচ্ছে, কোন প্রতিবন্ধকতা? এমন কথার প্রেক্ষিতে তিনি জানান, আমি কোন বাধা দেখিনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব মানুষ বিষয়টির পক্ষে। আমাদের দিক থেকে যা যা করা দরকার তা করে দিয়েছি। শিল্পী হাশেম স্যার, গোপেশ মালাকার, এডলিন মালাকার এ বিষয় নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তিনি অনেকটা ক্ষোভের সূরে বলেন, যারা এটাকে বাস্তবায়ন করবে তারা যদি না বোঝে, তারা যদি অশিল্পী সূলভ আচরন করে তাহলে আর কি করার? আরো বলেন, আমরা তো আর ইট পাটকেল নিয়ে রাস্তায় নামতে পারি না! তার ভাষ্যমতে, এনসিটিবি, এনসিসিসি, শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের বিভিন্ন সেক্টরে একটি শ্রেণী উদ্দেশ্য মূলক এ শিক্ষাকে বাধা গ্রস্থ করতে বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধানের পথে বাধা হয়ে দ্বাড়াচ্ছে। তিনি আরো যোগ করেন, আমরা দেখছি শুধু দু’একটি সংগঠন বিশেষ করে চারুকলা শিক্ষক পরিষদের কয়েকজন ছোটাছুটি করছে। অন্য শিক্ষক সংগঠন গুলো কোন কথাই বলছে না অথচ সৃজনশীল বিষয়টি পরিক্ষা থেকে বাদ করছে। দীর্ঘ সময়ের কথোপথনে অনেক প্রসঙ্গ তুলে ধরেন তিনি। তাঁর ভাষায়, সুশীল জাতি গঠনে শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষর্থীদের চারুকলা শিক্ষার প্রয়োজন আছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে শিল্পী, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক ও সচেতন অভিভাবক সহ সবাইকে সোচ্চার হতে হবে, মুখ খুলতে হবে নিজেদের স্বার্থে। এক্ষেত্রে ঢাবি চারুকলা অনুষদ সহ সারা দেশের চারুকলার শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে। শেষে সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন যে, দেশের ভাষা, শিল্প-সংস্কৃতি রক্ষায়, ভবিষৎ প্রজন্মকে শিল্পবোধ সম্পন্ন জাতি হিসেবে গড়ে তুলতেস্কুল পর্যায়ে চারু ও কারুকলা শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে সরকার সক্ষম হবে বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। এদিকে সম্মিলত সাংস্কৃতিক জোট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শিল্পকলা চর্চার বিকল্প নেই। ৮ম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষায় বিষয়টি বাদ যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, শিশুদের একঘেয়েমী দুর করতে, মানসিক চাপ কমাতে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা অপরিহার্য। অথচ বিশেজ্ঞরা কেন তাদের এই প্রয়োজনীয় বিষয়টি পরীক্ষা থেকে বাদ দিল তা বুঝা বড় দায়! তাদের এই সিদ্ধান্তের সাথে কোন ভাবেই একমত হতে পারছি না। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তক প্রনয়ন সকমিটির একজন সদস্য শিল্পী সন্জিব দাস। কথা হয় তাঁর সঙ্গে তিনি হতাশার সুরে জানান, অনেক আশা নিয়ে স্যারের (হাশেম খান) সাথে কাজ করেছি কিন্তু আজ সব স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার পথে। বিষয়টি কোন উদ্দেশ্যে পরীক্ষা থেকে বাদ দেওয়া হলো তা আমার বুঝে আসে না। কেন এমন হচ্ছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলেন, সরকারের প্রায় সব বিভাগের ঘাপটি মেরে থাকা কিছু কুরুচিপূর্ণ মানুষ এটাকে বাধা গ্রস্থ করছে। তাঁর মতে, কোথায় যেন একটা গ্যাপ (কমতি) আছে। বৃহত্তর স্বার্থে শিল্পীদের সব সংগঠনকে এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন শিল্পরশীক মানুষ তিনি শিল্পচর্চার ও শিল্পকলার গুরুত্ব বোঝেন। তাঁর নজরে বিষয়টি আনতে পারলে এবিষয়ের সুষ্টু সমাধান হবে বলে মত দেন তিনি। এদিকে চারুকলা শিক্ষক পরিষদ বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কমল কর্মকারের সরকারের কাছে দাবী রেখে বলেন, প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত চারু ও কারুকলা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং বিষয় ভিত্তিক শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করে দ্রুত এমপিওর ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে বিষয়টি পূর্বের ন্যায় পাবলিক পরীক্ষায় অর্ন্তভ’ক্ত করে পূর্ণ মর্যাদায় মূল্যায়ন করতে হবে। অন্যদিকে চারুকলা শিক্ষক পরিষদের সাধারন সম্পাদক জাকির হোসেন ফকির অভিযোগ করেন যে, সরকারকে ভুল বুঝিয়ে কিছু মৌলবাদী সংগঠন হীন স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। বিষয়টি পরীক্ষা থেকে বাদ দেওয়া ফলে বিদ্যালয় গুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা জাতিয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ব্যহত করছে। আমাদের হাজার হাজার শিল্পী আছে, শিক্ষার্থীদের হাতে বই আছে নেই শুধু এ বিষয়ে শিক্ষকের পদ। অনেক তরুণ শিল্পী শিক্ষক হরার স্বপ্ন দেখছে অথচ তাদের লালিত স্বপ্নে ভাঁটা পড়ছে। এ অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই মেধাবী জাতি গঠনে কাজ করতে চাই, শিল্প মন নিয়ে স্বাধীন ও সৎ ভাবে বাঁচতে চাই, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে চাই। বিষয়টি নিয়ে কথা হয়, উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষক নেতা ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, হরেন্দ্রনাথ সাহার সাথে। চারুকলা বিষটি শিশু কিশোরদের কাছে অত্যন্ত আনন্দদায়ক একটি বিষয়। শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে সহজ ভাবে, আনন্দ সহকারে গ্রহন করেছ। কাজেই বিষয়টির প্রয়োজন আছে। অভিভাবক রুহুল আমীন জানান, শিশুদের শিল্পকলা চর্চার বিষয়টি একটি স্বয়ংসম্পূর্ন বিষয়। এটি অন্য কোন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল নয় বরং কম্পিউটার গ্রাফিক্স ডিজাইন, চিকিৎসা বিদ্যা, স্থাপত্য বিদ্যা, গনিত শাস্ত্রের উপর অনেকাংশে বিষয়টি প্রভাব বিস্তার করে। তিনি আরো বলেন, পরীক্ষায় না থাকলে ছেলে মেয়েদের চারু ও কারুকলা শিক্ষার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হবে। এ বিষয় নিয়ে আরো কথা হয়, উপমহাদেশের প্রাচীন ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় কমিটির সহ-সভাপতি কামাল মোহাম্মদ নাসেরের সাথে। তিনি বলেন, ছোট বেলায় আমরা এ শিক্ষা গ্রহন করেছি অবশ্যই স্কুল পর্যায়ে এ বিষটির গুরুত্ব আছে। কেননা শিশুর সুক্ত প্রতিভা বিকাশে চারুশিল্প শিক্ষা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তিনি আরো বলেন, আমাদের সরকার শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। সব অপশক্তি রূখে উন্নয়নের অব্যহত থাকবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি প্রদীপ বর্মন বলেন, আমাদের দাবীর মধ্যে এ বিষয়টি আছে। সরকার অপশক্তির সাথে আপোষ করে বাংলার শিল্প সংস্কৃতির চর্চার পথ বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে। শেষে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সত্য কথা বললে মামলা হতে পারে। বিষয়টি রক্ষার ক্ষেত্রে দেশের চারু শিল্পের শিক্ষার্থীদের সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। বিষয়টির পক্ষ্যে আমাদের পূর্ণ সমর্থন আছে। উপজেলা পর্যায়ের ছাত্রদল নেতা সাদেকুল ইসলাম বলেন, বেশি কথা বলতে চাইনা, স্কুল পর্যায়ে চারু ও কারুকলা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে। তাই এর প্রয়োজন আছে। রংপুর ক্যান্ট-পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থী রুবায়েদ সাদমান জানায়, আমি যখন ভাষা আন্দোলনের ছবি আঁকি তখন মনে হয় আমি ভাষা আন্দোলনে অবস্থান করছি। পরীক্ষায় বিষয়টি না থাকলে আমি কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকব, কিভাবে প্রকৃতি সম্পর্কে জানব? অপর এক শিক্ষার্থী রাহী জানায়, চারুশিল্প চর্চার মাধ্যমে মানুষ রুচিশীল হয়ে ওঠে, তাছাড়া চিত্রকলা পৃথিবীর সব মানুষের ভাষা- কারন চিত্রকলা সব মানুষ বোঝে। আর আমার ছবি আঁকতে খুব ভাল লাগে। লালমনিরহাট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চারুকলার শিক্ষক প্রমদ মহন্ত বলেন, পৃথিবীর কোন বিদ্যাই সহজ নয়। অথচ বিষয় কমানোর অজুহাতে কর্তৃপক্ষ চারু ও কারুকলাকে পরীক্ষার বাইরে রাখছে যা শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার্থীদের উপর অনেকটা অনীহার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে তিনি শিক্ষক নেতাদের আরো এক্টিভ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। কথা হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাক্তন ছাত্র মোহাম্মদ রাজন এর সাথে। তিনি অভিযোগ করেন, বিষয়টি অবমূল্যায়ন হচ্ছে অথচ শীর্ষস্থানীয় শিল্পী ও শিক্ষক নেতারা দায়সারা গোছের ভুমিকা পালন করছে। তিনি মনে করেন, শীর্ষস্থানীয় নেতারা যদি বিষয়টি আগে থেকে গুরত্ব দিতো, খোঁজ-খবর রাখত তাহলে এ অবস্থার সৃষ্টি হত না। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ললিত ভট্টচার্য কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার যখন চারু ও কারুকলা বিষয়টি বই বিতরণ করে তখন আমরা আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সরকার অশক্তির সাথে আপোষ করে বিষটির সমাধান না করে দুরে চলে যাচ্ছে। আর আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মকে নিয়ে যাচ্ছে শিল্প সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে। চারুকলা শিক্ষার্থী অভির অভিযোগ যে, কিছু মৌলবাদী শক্তি সরকারের শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যা জাতির উন্নয়নের অন্তরায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্দেশিকায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত চারু ও কারুকলা বিষয়টি যুক্ত থাকলেও সরকার কোন পাঠ্যপুস্তক দিচ্ছে না তবে আমরা এ বিষয়ে পাঠ দান ও পরীক্ষা নিয়ে থাকি। তার মতে, বই পেলে শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে আরো ভালোভাবে গ্রহন করবে, এবং তাদের মধ্যে সৃষ্টিশীল ধারনা বৃদ্ধি পাবে যা একজন শিক্ষার্থীর আর্দশ মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। এ বাংলায় জন্ম নেয়া খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী তাঁর একটি গ্রন্থে বলেছেন, পৃথীবির সব বিদ্যারই পরীক্ষা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর কথা মূল্যহীন। কারন উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় প্রায় সব দেশেই স্কুল পর্যায়ে চারু ও কারুকলা শিক্ষা অনেক আগেই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে। এখানে দেখা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক নেই অথচ পরীক্ষা আছে, আবার মাধ্যমিকে পাঠ্যপুস্তক থাকলেও শ্রেণী কক্ষে শিক্ষক নেই। এভাবেই চলছে বাংলাদেশের চারু ও কারুকলার একাডেমিক শিক্ষা। তবে দেশের শিল্পী সমাজ, প্রগ্রতিশীল চেতনার মানুষ, সচেতন অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট সবাই মনে করেন, সৃজনশীল/শিল্পমনা জাতি গঠনে ও বেকারত্ব রোধে দেশের সব প্রাথমিক ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চারু ও কারু কলা শিক্ষার পূর্ণ মূল্যায়ণ সহ এ বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ অতীব জরুরী।
প্রতিবেদক-চারুকলার শিক্ষার্থী