বৈশাখী উপহার
বিশ্বজিৎ দাস বিডি.টুনসম্যাগ.কম এক. লোভাতুর! ক্ষুধার্ত!! পিপাসার্ত!!! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মোখলেস ভাই। চোখের পলক পড়ছে না।...
https://bd.toonsmag.com/2015/05/24832.html
বিশ্বজিৎ দাস
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
এক.
লোভাতুর!
ক্ষুধার্ত!!
পিপাসার্ত!!!
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মোখলেস ভাই।
চোখের পলক পড়ছে না। চকচক করছে দু’চোখ।
তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে আমিও তাকালাম। চমকে উঠলাম।
ছিঃছিঃ! ধিক্কার দিলাম মোখলেস ভাইকে। এতকিছু থাকতে এই জিনিসের দিকে লোভী দৃষ্টিতে তাকানোর কী আছে বুঝতে পারলাম না।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক মেগা শপে।
পরশুদিন পহেলা বৈশাখ। সে উপলক্ষে আমরা কেনাকাটা করতে বেরিয়েছি। আমরা মানে আমি আর মোখলেস ভাই।
পহেলা বৈশাখের কথা আমাদের মনেই ছিল না। আজ সকালে সেটা মনে করিয়ে দিয়েছিল ইমন।
সকালে বাজার করে ফিরেই ঘোষণা দিল, ‘আজ বাজার থেকে নওরীনের জন্য কিনেই নিয়ে এলাম। পরশু নতুন বছর। একটা সারপ্রাইজ গিফট তো ওকে দিতেই পারি, কী বলিস?’
নওরীন ওর নতুন বান্ধবীর নাম।
‘কী কিনলি?’ মোখলেস ভাই শুকনো মুখে জানতে চাইলেন।
‘এক জোড়া জুতো।’
‘জুতো। নববর্ষে বান্ধবীকে জুতো উপহার দিবি।’
‘নাহ! নিজের জন্য একজোড়া জুতো কিনে ৫০০ টাকার ফ্রি গিফট ভাউচার পেয়েছি। ভাবছি সেটাই নওরীনকে গিফট দেব।’
‘ঐ টাকা দিয়ে কি বাইরের কোন দোকানে কেনাকাটা করতে পারবে?’ জানতে চাইলাম।
‘না। ঐ জুতার দোকানেই কিছু কিনতে পারবে।’
‘তাহলে ঐ পাঁচশ টাকায় কী আর কিনবে?’
‘কেন? ঘরে পরা স্যান্ডেল কিনবে। সারাদিন পরবে আর আমাকে প্রতি পদক্ষেপে মনে করবে।’ খিক খিক করে হেসে উঠল ইমন।
‘একেবারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।’ খোঁচা দিলেন মোখলেস ভাই।
অন্যকে খোঁচা দিলেও বিকেল বেলায় ঠিকই পদক্ষেপ নিয়েছেন ভাই। বেরিয়ে পড়েছেন আমাকে নিয়ে। লিজা (হবু)ভাবি’র জন্য কিছু একটা কিনবেনই।
এ দোকান সে দোকান করে শেষপর্যন্ত আমরা এসেছি একটা মেগা শপে। এই মুহূর্তে লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জিনিসটার দিকে।
‘দেখেছিস?’ চাপা স্বরে বললেন মোখলেস ভাই।
লজ্জা লুকোনোর জন্য এদিক ওদিক তাকালাম।
‘দেখেছি।’ ফিস ফিস করে বললাম।
‘তোর লিজা ভাবি’র জন্য এটাই হবে নববর্ষের জন্য সেরা গিফট।’
ঢোক গিললাম।
লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম, ‘আপনি লিজা ভাবিকে নববর্ষে হেয়ার রিমুভার গিফট দেবেন?’
‘মানে? কী বলতে চাস?’
‘তখন থেকে তো দেখছি, সুন্দরী মেয়ের পা দেখানো হেয়ার রিমুভারের দিকে তাকিয়ে আছেন।
‘আরে গাধা! হেয়ার রিমুভার এর পাশে যে জিনিসটা সাজানো আছে আমি সেটার কথা বলছি।’
নিজেকে গাড়ল মনে হল আমার।
মোখলেস ভাইয়ের লক্ষ্যবস্তু আর কিছুই নয়- সাবান।
দুই.
সাবান জিনিসটার প্রতি আমার এলার্জি আছে। মাস তিনেক আগে বড় চাচার বাসায় গিয়েছিলাম। সেদিন আবার বাসায় কেউ ছিল না। চাচা একাই ছিলেন।
দরজা খুলে আমাকে বসিয়ে চাচা বললেন, ‘তুই একটু বস। আমি বাথরুমের সমস্যাটা মিটিয়েই আসছি।’
ড্র্ইং রুমে বসে টিভি দেখতে লাগলাম।
হঠাৎ নজর গেল বাথরুমের আধখোলা দরজার দিকে। চাচার বড়সড় পাছাটা দেখতে পেলাম। সেটা একবার এদিক আরেকবার ওদিক নড়ছে।
সর্বনাশ! হচ্ছেটা কী বাথরুমে!!
এ বাড়িতে বহুবার এসেছি। তাই মোটামুটি এ বাড়ির সবকিছুই জানি। যা দেখলাম বুঝলাম, বড় চাচা কোন কারণে পায়খানার প্যানের উল্টোদিকে মুখ করে বসেছেন এবং অস্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করছেন।
ব্যাপারটা কী?
কৌতুহল চরমে উঠল।
পা টিপে টিপে বাথরুমে গিয়ে উঁকি দিলাম। যা দেখলাম আমার চোখ কপালে উঠার যোগাড়!
চাচা প্যানের ভেতর হাত ঢুকিয়ে কী যেন খুঁজছেন। একটুপর প্যান থেকে হাত ধরে বের করে এনেছিলেন তা আর কিছুই নয়- একটা অর্ধব্যবহৃত সাবান!
তিন.
‘সাবান!’ বিস্ময় যেন বাঁধ মানল না আমার।
‘আনকমন কি না বল।’ মোখলেস ভাই আনন্দে গদগদ হয়ে বললেন।
স্বীকার করলাম নববর্ষের উপহার হিসেবে বই, সিডি, ফুল, গিফট ভাউচার ইত্যাদির নাম শুনলেও সাবানের নাম এই প্রথম শুনলাম।
‘তোর লিজা ভাবি সবসময় আনকমন জিনিস পছন্দ করে। আর এ সাবানটা দেখেছিস একেবারে আনকমন। বিদেশি।’
চিরকাল মোখলেস ভাইকে ‘দেশি পণ্য কিনে হও ধন্য’ টাইপের বক্তব্য দিতে শুনলেও আজ হঠাৎ তার এই বিদেশি পণ্য প্রীতি শুনে একটু অবাকই হলাম।
মোখলেস ভাই আরো কিছু কেনাকাটা করলেন। শেষে সব একসাথে প্যাকেট করে দিতে বললেন।
ডিজিটাল বিল হাতে চলে এল। মোখলেস ভাই মানিব্যাগ বের করার জন্য হাত পেছনে নিলেন।
ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। এই বুঝি মোখলেস ভাই বলে উঠবেন, হায়! হায়!! মানিব্যাগ ভুলে ফেলে এসেছি।
কিন্তু না। হাসিমুখে মোখলেস ভাই মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিলেন।
‘আপনি না পরশুই বললেন আপনার কাছে টাকা নেই।’
‘নেইই তো। এ টাকা লিজা আমাকে দিয়েছে।’
হা করে শুনলাম। প্রেমিকার টাকা দিয়ে প্রেমিকারই জন্য নববর্ষের গিফট কেনার আইডিয়াটা একেবারে নতুন মনে হল আমার কাছে।
চার.
মোখলেস ভাইয়ের আইডিয়া অবশ্য সবসময় নতুন।
সেদিন বাজার করবে এক মুদি দোকানির কাছে জানতে চাইলেন, ‘তোমার কাছে ভাল হাত ধোয়া সাবান আছে?’
‘আছে।’
‘খোলা আছে?’
‘এক ডজনের প্যাক করা থাকে। সেখান থেকে খুলে দেয়া যাবে।’ দোকানদার বলল।
‘তাহলে একটা খোলা সাবানে হাত ভাল করে ধুয়ে আমাকে এক কেজি আটা দ্যান তো ভাই।’
পাঁচ.
আমার মামাত ভাই অর্নব একজন ডেন্টিস্ট।
একদিন গেলাম উনার সঙ্গে দেখা করতে। উনি তখন একজন রুগিকে পরীক্ষা করছিলেন। ইশারায় আমাকে রুমের এক পার্শ্বে রাখা সোফায় বসতে বললেন।
দাঁত পরীক্ষা শেসে অর্নব ভাই রোগিকে বললেন, ‘আপনার দাঁতের অবস্থা তো ভয়ানক। কোন পেস্ট ব্যবহার করেন?’
‘আক্কাস কোম্পানির পেস্ট।’
‘আপনার শরীর থেকে বেশ দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। সাবান ব্যবহার করেন না?’
‘করি তো।’
‘কোন কোম্পানির?’
‘আক্কাস কোম্পানির।’
‘আর শ্যাম্পু?’
‘সেটাও আক্কাস কোম্পানির।’
‘আশ্চর্য! এতদিন ধরে চিকিৎসা করে আসছি, এই কোম্পানির নাম তো কখনো শুনিনি।’
‘শুনবেন কীভাবে স্যার। এই কোম্পানি তো একটাই আছে।’
‘মানে?’
‘আক্কাস হল আমার রুমমেটের নাম। আমি তো ওরই সাবান, শ্যাম্পু, পেস্ট ফ্রি ফ্রি ব্যবহার করি। তাই আক্কাস কোম্পানির ফ্রি সার্ভিসই হল আমার আসল কম্প্যানি, বুঝলেন স্যার?’
ছয়.
‘মোখলেস ভাইকে সার্বক্ষণিক কম্প্যানি তো তুইই দিস। তুই-ই বলতে পারবি, সাবানটা কই গেল?’ ইমন বলল।
আমতা আমতা করলাম। ‘আসলে শপিং করে ফিরে আসার সময় আমি মোখলেস ভাইয়ের সাথে ছিলাম না।’
‘তুই কোথায় গিয়েছিলি?’
‘আমি মোবাইলটা ঠিক করতে গিয়েছিলাম।’
‘তাহলে মোখলেস ভাই-ই ঠিক করে বলতে পারবে- সাবানটা হারালো কীভাবে?’
মোখলেস ভাই বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখদুটো বন্ধ। ইমনের প্রশ্ন শুনেও চোখ খুললেন না। উত্তরও দিলেন না।
বিষয়টা হল- বৈশাখ উপলক্ষে শপিং শেষে মোখলেস ভাই একাই রুমে ফিরেছেন। ঘরের কোণের র্যাকের উপর শপিং ব্যাগটা রেখে আবার বেরিয়ে গেছেন।
রাতে মেসের সবার কাছে খবরটা চাউর হয়ে গিয়েছে যে, লিজা (হবু) ভাবির জন্য মোখলেস ভাই স্পেশাল গিফট কিনেছেন। সবাই তখন আমাদের রুমে এসে হাজির। উদ্দেশ্য পরিস্কার গিফট মানে বিদেশি সাবানটা একবার চোখে দেখে নয়ন মন সার্থক করা।
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও শপিং ব্যাগ খুলে সব বের করেছেন মোখলেস ভাই। তখনই ধরা পড়ল ব্যাপারটা- শপিং ব্যাগে সব আছে। শুধু সেই সাবানটা নেই।
কেন নেই, তার কোন ব্যাখ্যাও খুঁজে পাচ্ছি না।
‘কোথাও কী থেমেছিলেন ভাই?’
‘ব্যাগ চেঞ্জ হয়ে যায়নি তো?’
‘রুম থেকে কেউ চুরি করেনি তো?’
সাবানের কথা আর কে কে জানত?’
রহস্য দানা বেঁধে উঠল।
মোখলেস ভাই কোন জবাব দিলেন না।
ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে ভারী গলায় বললেন, ‘আমি এবার ঘুমাবো।’
সবাই ইশারা বুঝল।
ধীরে ধীরে সবাই আমাদের রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
‘বাতি নিভিয়ে দে।’ মশারি টানিয়ে বললেন ভাই।
‘চিন্তা করবেন না। কাল আমি ঐ দোকানে আবার যাব। নতুন আরেকটা সাবান কিনে আনব।’
‘আমি যাব না। গেলে তুই একাই যাস।’ মোখলেস ভাই ঘুরে শুলেন।
মনে মনে খুশিই হলাম।
যাবই যখন নিতুর জন্যও একই সাবান কিনব আরেকটা। ওকেও তো বৈশাখী উপহার দেয়া দরকার।
সাত.
‘এক্সকিউজ মি। আমাকে ঐ বিউটি সাবানটা গিফট প্যাকে র্যাপিং করে দিতে পারবেন?’
‘পারব। কয়টা দেব স্যার?’
‘দুইটা দুই প্যাকেটে। গতকাল বিকেলে একটা কিনেছিলাম এখান থেকে। কিন্তু রাস্তায় কোথায় যে সেটা হারালো খুঁজেই পেলাম না।’ ইতস্তত করে বললাম।
‘ওহ স্যার। ওটা আসলে হারায়নি। ভুল করে আমরাই গতকাল শপিং ব্যাগে ভরতে ভুলে গিয়েছিলাম। খুবই দুঃখিত স্যার।’
যাক। সাবান হারানো রহস্যের উদঘাটন হল।
পরমুহূর্তে আতংকিত হলাম।
আমি যদি মেসে চিৎকার করেও বলি যে, আসলে সাবানটি ভুলে দোকানেই থেকে গিয়েছিল, তবু কেউ কেউ বিষয়টা বিশ্বাস করবে না। বলবে, আমি ইচ্ছে করেই লুকিয়ে রেখেছিলাম।
তার চেয়ে চেপে যাওয়াই ভাল।
‘স্যার, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আপনি এই চাইনিজ সাবানটা কাকে গিফট করবেন?’
লজ্জা পেলাম, ‘আমাদের বান্ধবীদেরকে।’
‘কিন্তু স্যার ...’
‘কিন্তু?’
‘এই সাবানটা মোটেও বিউটি সাবান নয় স্যার।’
‘মানে?’
‘স্যার এই সাবানটা আসলে ডিসওয়াশার। চাইনিজ ডিসওয়াশার।’
এখন বলুন স্যার, আপনাদের বান্ধবীদেরকে এই ডিসওয়াশার কি বৈশাখী গিফট হিসেবে দেবেন?