জেল কয়েদিদের ছবি আঁকা
বিডি.টুনসম্যাগ.কম বহরমপুর জেলের ভিতরের একটি দৃশ্য সংশোধনাগারের ভেতরে নতুন পৃথিবী তৈরীর প্রচেষ্টায় শামিল কিছু উৎসাহী। এক নতুন অভিজ্ঞত...
https://bd.toonsmag.com/2014/09/blog-post_28.html
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
সংশোধনাগারের ভেতরে নতুন পৃথিবী তৈরীর প্রচেষ্টায় শামিল কিছু উৎসাহী। এক নতুন অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছেন নবীনশিল্পী পার্থপ্রতিম রায়
গত বছর (অর্থাৎ ২০১৩ সাল) আমি তখন সরকারি আর্ট কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। একদিন কথায় কথায় কীভাবে এক বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম জেলখানার সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিরাও নাকি ছবি আঁকে, আর তাঁদের কারো কারো আঁকার হাত নাকি রীতিমতো ভালো। কিন্তু ওরা ছবি আঁকার রসদ পায় কোথা থেকে? আর কারাই বা ওদের আঁকা ছবি দেখে? আমার মনে নিদারুণ কৌতুহল জাগল। তখন সেই বন্ধুই আমাকে জানাল শিল্পী চিত্ত দে-র কথা। তিনি ভারতের আলিপুর সংশোধনাগারের ছবি আঁকার শিক্ষক। একদিন আলাপ করলাম চিত্তবাবুর সঙ্গে। চিত্তবাবু আমাকে খুব সুন্দরভাবে বললেন জেলকয়েদিদের কথা। তারপর আমার আগ্রহ দেখে তিনি আমাকে ডেকেও নিলেন তাঁর সংশোধনাগারের আঁকার ক্লাসে। সেই সময় চিত্তবাবু জেলকয়েদিদের নিয়ে একটি ধারাবাহিক ছবি আঁকার কর্মশালার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য হল আর্ট কলেজের একজন ছাত্র হিসেবে সেই কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে অংশ নেবার। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। জেলজীবনের অন্ধকারে রংতুলির অভিযান। আর আমি নিজে সেই অভিযানের অন্যতম এক যাত্রী।
মনে আছে আমাদের প্রথম কর্মশালা শুরুর দিনটি, সেটা ছিল ৩০মে, ২০১৩ অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক একবছর আগে। এই শিল্পকর্মশালাগুলি আলিপুর সংশোধনাগার ছাড়াও বহরমপুর (মুর্শিদাবাদ), বালুরঘাট (উত্তর দিনাজপুর), শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ি সংশোধনাগারেও হয়েছিল। যার সবগুলিতেই আমি ছিলাম। জেল আবাসিকদের খুব কাছ থেকে ছবি আঁকতে দেখা, তাঁদের সঙ্গে বসে কাজ করা, তাঁদের কথা শোনা — সব মিলিয়ে সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। আমার ক্ষুদ্র শিল্পীজীবনে আমি চিন্তাও করতে পারিনি যে এইরকম কাজের সঙ্গে আমি নিজে জড়িয়ে পড়তে পারব। জেল-আবাসিকরাতো সেই অর্থে কেউ শিল্পী নন। তবু তাঁরা আঁকছিলেন নানারকম ছবি। পল্লীগ্রাম, ঘরবাড়ি, গাছপালা, নদীর ছবি আঁকছিলেন অনেকে। কেউ আবার আঁকছিলেন নকশা। যারা আঁকতে পারছিলেন না, চুপ করে বসেছিলেন তাঁদেরকে আমি যখন বললাম, ‘চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবুন, নিশ্চয় কিছু আঁকতে পারবেন।’ তখন দেখলাম সত্যিই কাজ হল। অনেকেই আঁকলেন জেলখানার গরাদ কিংবা চারদেওয়ালের ছবি। খোঁজ নিয়ে জানলাম এরা অনেকে পূর্বজীবনে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন, অনেকের আবার ঘরে আলপনা দেবার অভিজ্ঞতা আছে। অর্থাৎ কিছু না কিছু সৃষ্টি করার ন্যূনতম জ্ঞান তাঁদের আগে থেকেই ছিল। আমাদের মতো কিছু মানুষের সংস্পর্শে এসে তাঁদের মনে লেগেছে নতুন উৎসাহের বাতাস। সুযোগ বুঝে আমিও ওদের পাশে বসে ছবি আঁকতাম। কখনও এঁকেছি ওদেরই কারো পোর্ট্রেট, আবার কখনও এঁকেছি জেলখানার ভেতরের একচিলতে বাগান। একদিন ছবি আঁকতে বসে শুনি একজন ভারি চমৎকার গলায় গান গাইছে।
জিজ্ঞেস করে জানলাম সে আগে ট্রেনে গান গেয়ে বেড়াত। এরকম আরো কত সব মানুষের ভিড় সংশোধনাগারের কর্মশালায়। এই ছোট্ট লেখায় সব তো আর বলা যাবে না। মাঝে মাঝে যখন ভাবি সাজাপ্রাপ্ত এইসব মানুষগুলোর কথা তখন মনে হয় শিল্পের স্পর্শে এঁদের জীবনের সব পাপ কি ধুয়ে যেতে পারেনা। সাজার শেষে এইসব মানুষেরা যদি নতুন জীবন শুরু করতে পারে তাহলে তারচেয়ে সুন্দর আর কীই বা হতে পারে! ছবি আঁকার মানে তো সুন্দরের সাধনা করা। আমাদের ছোট ছোট কর্মশালাগুলো যদি ওদের মনে সুন্দরের বীজ বুনে দিতে পারে তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে?
ছবিগুলি লেখকের আঁকা।
বহরমপুর জেলের ভিতরের একটি দৃশ্য |
সংশোধনাগারের ভেতরে নতুন পৃথিবী তৈরীর প্রচেষ্টায় শামিল কিছু উৎসাহী। এক নতুন অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছেন নবীনশিল্পী পার্থপ্রতিম রায়
গত বছর (অর্থাৎ ২০১৩ সাল) আমি তখন সরকারি আর্ট কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। একদিন কথায় কথায় কীভাবে এক বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম জেলখানার সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিরাও নাকি ছবি আঁকে, আর তাঁদের কারো কারো আঁকার হাত নাকি রীতিমতো ভালো। কিন্তু ওরা ছবি আঁকার রসদ পায় কোথা থেকে? আর কারাই বা ওদের আঁকা ছবি দেখে? আমার মনে নিদারুণ কৌতুহল জাগল। তখন সেই বন্ধুই আমাকে জানাল শিল্পী চিত্ত দে-র কথা। তিনি ভারতের আলিপুর সংশোধনাগারের ছবি আঁকার শিক্ষক। একদিন আলাপ করলাম চিত্তবাবুর সঙ্গে। চিত্তবাবু আমাকে খুব সুন্দরভাবে বললেন জেলকয়েদিদের কথা। তারপর আমার আগ্রহ দেখে তিনি আমাকে ডেকেও নিলেন তাঁর সংশোধনাগারের আঁকার ক্লাসে। সেই সময় চিত্তবাবু জেলকয়েদিদের নিয়ে একটি ধারাবাহিক ছবি আঁকার কর্মশালার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য হল আর্ট কলেজের একজন ছাত্র হিসেবে সেই কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে অংশ নেবার। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। জেলজীবনের অন্ধকারে রংতুলির অভিযান। আর আমি নিজে সেই অভিযানের অন্যতম এক যাত্রী।
মনে আছে আমাদের প্রথম কর্মশালা শুরুর দিনটি, সেটা ছিল ৩০মে, ২০১৩ অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক একবছর আগে। এই শিল্পকর্মশালাগুলি আলিপুর সংশোধনাগার ছাড়াও বহরমপুর (মুর্শিদাবাদ), বালুরঘাট (উত্তর দিনাজপুর), শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ি সংশোধনাগারেও হয়েছিল। যার সবগুলিতেই আমি ছিলাম। জেল আবাসিকদের খুব কাছ থেকে ছবি আঁকতে দেখা, তাঁদের সঙ্গে বসে কাজ করা, তাঁদের কথা শোনা — সব মিলিয়ে সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। আমার ক্ষুদ্র শিল্পীজীবনে আমি চিন্তাও করতে পারিনি যে এইরকম কাজের সঙ্গে আমি নিজে জড়িয়ে পড়তে পারব। জেল-আবাসিকরাতো সেই অর্থে কেউ শিল্পী নন। তবু তাঁরা আঁকছিলেন নানারকম ছবি। পল্লীগ্রাম, ঘরবাড়ি, গাছপালা, নদীর ছবি আঁকছিলেন অনেকে। কেউ আবার আঁকছিলেন নকশা। যারা আঁকতে পারছিলেন না, চুপ করে বসেছিলেন তাঁদেরকে আমি যখন বললাম, ‘চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবুন, নিশ্চয় কিছু আঁকতে পারবেন।’ তখন দেখলাম সত্যিই কাজ হল। অনেকেই আঁকলেন জেলখানার গরাদ কিংবা চারদেওয়ালের ছবি। খোঁজ নিয়ে জানলাম এরা অনেকে পূর্বজীবনে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন, অনেকের আবার ঘরে আলপনা দেবার অভিজ্ঞতা আছে। অর্থাৎ কিছু না কিছু সৃষ্টি করার ন্যূনতম জ্ঞান তাঁদের আগে থেকেই ছিল। আমাদের মতো কিছু মানুষের সংস্পর্শে এসে তাঁদের মনে লেগেছে নতুন উৎসাহের বাতাস। সুযোগ বুঝে আমিও ওদের পাশে বসে ছবি আঁকতাম। কখনও এঁকেছি ওদেরই কারো পোর্ট্রেট, আবার কখনও এঁকেছি জেলখানার ভেতরের একচিলতে বাগান। একদিন ছবি আঁকতে বসে শুনি একজন ভারি চমৎকার গলায় গান গাইছে।
জিজ্ঞেস করে জানলাম সে আগে ট্রেনে গান গেয়ে বেড়াত। এরকম আরো কত সব মানুষের ভিড় সংশোধনাগারের কর্মশালায়। এই ছোট্ট লেখায় সব তো আর বলা যাবে না। মাঝে মাঝে যখন ভাবি সাজাপ্রাপ্ত এইসব মানুষগুলোর কথা তখন মনে হয় শিল্পের স্পর্শে এঁদের জীবনের সব পাপ কি ধুয়ে যেতে পারেনা। সাজার শেষে এইসব মানুষেরা যদি নতুন জীবন শুরু করতে পারে তাহলে তারচেয়ে সুন্দর আর কীই বা হতে পারে! ছবি আঁকার মানে তো সুন্দরের সাধনা করা। আমাদের ছোট ছোট কর্মশালাগুলো যদি ওদের মনে সুন্দরের বীজ বুনে দিতে পারে তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে?
ছবিগুলি লেখকের আঁকা।