সময়ের রঙ্গমঞ্চে – সঞ্জীবের চিত্রকলা

বিডি.টুনসম্যাগ.কম শিবলু শফি :  চরম ভোগাকাক্সক্ষী ও বাজারী বস্তু প্রবৃত্তির তথাকথিত অগ্রগতি ব্যক্তিকে অবিশ্বাস্যভাবে বিচ্ছিন্ন করে চলেছ...

বিডি.টুনসম্যাগ.কম

শিবলু শফি : চরম ভোগাকাক্সক্ষী ও বাজারী বস্তু প্রবৃত্তির তথাকথিত অগ্রগতি ব্যক্তিকে অবিশ্বাস্যভাবে বিচ্ছিন্ন করে চলেছে পরিবার, প্রকৃতি, সংস্কৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র, ভূগোল ও পরিবেশ থেকে। যেখানে ব্যক্তির টিকে থাকার উৎসশক্তি, সংবেদনশীল নর্ম, মূল্যবোধ, স্মৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সামাজিক পরিচিতি ও সম্পর্কগুলো একে একে ভেঙে পড়ছে। এমতাবস্থায় ব্যক্তির জৈবিক টিকে থাকাটাই শুধু সার নয়, বরং ঐ জৈববৃত্তিকে মানববৃত্তি তথা মানবতাবাদে রূপান্তর করে টিকে থাকা বা ব্যক্তির ভেতরকার সকল স্বাভাবিক নর্ম ও সৃজনকল্প বিকশিত হওয়ার জন্যও যথাযথ নারিশমেন্ট বা পুষ্টি প্রয়োজন। তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের ক্রুর বাস্তবতায় ঐ পুষ্টি যোগানোর প্রাকৃতিক উৎসগুলো আজ অবরুদ্ধ ও অকার্যকর হতে চলেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ আগ্রাসী ও ক্রীড়নক বাস্তবতার শিকার শুধু ব্যক্তি বা ব্যক্তিসত্তা নয়, এমনকি সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ভূগোল, পরিবেশ প্রায় সবকিছুই। ব্যক্তিসত্তা দূরে থাক, ব্যক্তির মানুষ পরিচিতি এই বাস্তবতায়, প্রায় সাংস্কৃতিকশূন্য সীমিত ও সংকীর্ণতর প্রায় এক মাত্রিক জীব বা কীটের পরিনতি বরণ করতে বাধ্য হয়। আপাতত বাইরে থেকে দেখতে এই ইলাস্ট্রেটেড বাস্তবতার বেশ সুটেড-ব্যুটেড, ফাঁপা, চাকচিক্যসর্বস্ব কিংবা বাহুবলসর্বস্ব মনে হলেও আসলে এর ভেতরকার রূপ যেমন অবরুদ্ধ, তেমনি মৃতপ্রায়। রবীন্দ্রনাথ অনেককাল আগে তার কবিতায় ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন যথার্থভাবে, তা হলো “ইঁটের পরে ইঁট/মাঝে মানুষ কীট”। জেনে বা না-জেনে, চাপিয়ে দেয়া বা নিজেদের তৈরি করা এই বাহ্যিক চাকচিক্যময় ভোগ-প্রবৃত্তির ধাতব নেতি সাম্রাজ্য ও ক্রীড়নক বাস্তবতার ফাঁদে ব্যক্তির শ্বাশত ও সুকুমার মানববৃত্তির এই অবরুদ্ধ অর্ন্তজগৎ কোনো না কোনো সময়ে বিস্ফোরণোম্মুখ হয়ে উঠতে পারে। আর ঐ ধরনের অন্তঃসারশূন্য জৈবিক টিকে থাকাটা সমাজ, রাষ্ট্র, প্রগতি, জনপদ ও মানবতার ভবিষ্যতের জন্য কতটুকুইবা ফলদায়ক, মঙ্গলজনক বা ভারসাম্যপূর্ণ! আশার কথা হলো, ব্যক্তি মানুষের শরীর, মন ও আÍা সর্বদা আসল রূপ ও সত্যের জন্য ক্ষুধার্ত। যা হোক, ঐ অবরুদ্ধ ব্যক্তির অর্ন্তজগত বিস্ফোরণ ও বিদ্রোহ পরবর্তী পরিস্থিতিতেও যদি ভেতকার মুক্তি না মিলে তবে তা জৈবিকভাবে টিকে থাকা ব্যক্তি বা পারসনের যাপিত জীবনে ও বাস্তবতায় উদ্ভট, এ্যাবসার্ড ডি-মরালাইজড, ক্লেদাক্ততা এমনকি চরম নেতিবাচক প্রবণতা সহজাত হয়ে উঠতে পারে। সম্ভবত এই উৎসবিন্দু হতেই শিল্পী সঞ্জীব বড়–য়া তার যর্থাথ ‘টাইম এন্ড জার্নি’ শিরোনামের সাম্প্রতিক আঁকা শিল্পকর্মসমূহে বহির্তল থেকে গভীরতলে নাটকীয় বিভ্রমে পূর্ণ অন্তর্বাস্তব যাত্রা; দর্শকের চেতন, মনন ও অবচেতনে পরম শঙ্কা ও একাÍ হয়ে ডিসকোর্স কিংবা পরিভ্রমণ শুরু করে। অবশ্য বিষয় ভাবনা আক্রান্ত ও শিকারী বাস্তবতা থেকে উৎসজাত শিল্পনর্ম ও চিত্রকল্প কিংবা বিভ্রমে পূর্ণ নাটকীয় ফিকশনে এই সব ক্যানভাসের সারফেস বা বহিস্তর দেখে অনেকে বিভ্রমেও পড়ে যেতে পারেন। কিন্তু ব্যক্তির সমস্ত নেতিঘাতপ্রবণ অভিব্যক্তি ও প্রেক্ষিতকে ছাড়িয়ে, খুব সুক্ষ্মতর দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হলে-ক্যানভাসের গভীর স্তরে ব্যক্তির টিকে থাকা বা যাপিত জীবনের অবক্ষয়োত্তর অবচেতন সংলাপ যোগসূত্র নির্মাণ করতেও পারে। অন্তত এ দিক বিবেচনায়, ধাবমান বাস্তবতার বিভ্রমে পূর্ণ সঞ্জীবের ক্যানভাসের এ বহুমাত্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর আপাতত চরম নেতি পুঞ্জিভূত নগর ও জনপদের যাপিত জীবনের সত্তা ও অনুভূতির মহৎ ও সেকুলার-উত্তর রঙ্গমঞ্চও বটে।
শিল্পী সঞ্জীব বড়–য়া প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার পাঠ শেষ করে, প্রথম যখন সংবেদন ধারণা ও উপলব্ধির সাথে বাস্তব জগতকে বহুমাত্রার এক সংকর পরিভাষায় শিল্পের মুখোমুখি দাঁড়ান, হয়তো তখন থেকেই সময়ের গর্ভে এই ব্যক্তির পরিচয়হীনতা অথবা ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়া আÍপরিমণ্ডল ‘টাইম এন্ড জার্নি’র বিশেষ শিল্প পেরিফেরি’তে পথ পরিক্রমা শুরু করে। চট্রগ্রাম অলিয়ঁস ফ্রসেজে ২০০৭ সালে প্রথম একক প্রদর্শনী ‘ব্যালকনি’ সিরিজের শিল্পকর্মের মাধ্যমে ব্যক্তি শিল্পীর অন্দর-মহল হতে চারপাশের বহির্মহলকে দৃশ্যায়িত করার এক অদ্ভুত ও নষ্টালজিক বা অতীতচারী রোমন্থন দিয়ে শুরু। শিল্পীর একান্ত মনের চোখ দিয়ে কর্ষিত ও পঠিত হতে থাকে ব্যক্তি জীবন বনাম আমাদের নাগরিক পরিপার্শ্বের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল অভিঘাত। কিংবা সাংকেতিক রূপান্তরের ভেতর দিয়ে শিল্পীর উপলব্ধিসমূহ উপস্থাপনের বিকল্প ধরন ও চিত্রকল্প। এই একান্ত শিল্প গন্তব্যে বিরোধ ও স্ববিরোধের পরাবাস্তব, টানাপোড়েন, নগর বাস্তবতা, রাষ্ট্র ও রাজনীতির গতি-প্রকৃতি দৃশ্যান্তরে ভয়াবহ শঙ্কা ও নিঃশব্দের জাল বুনতে শুরু করে। এতে ক্যানভাসের একের পর এক বহির্তল হতে গভীরতল পর্যন্ত বিষয়ের মূর্ত-বিমূর্ত রূপ পাল্টে ভিন্ন অর্থের কিংবা বিকল্প বাস্তবতার শিল্পরূপ, শৈলী ও ভাষা গড়ে ওঠে। ব্যালকনি ও ধাতব জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে শিল্পীর উপলব্ধ বাস্তবতার দৃশ্যজগৎ কেমন হতে পারে; তারই মহাকাব্যিক বয়ান পাওয়া যায় সেই সব চিত্রকর্মে। জানালার ঐ ধাতব গ্রিল কখনো হয়ে উঠছে মানুষের এ্যানাটমি বা হাড় গোড়ের রূপকী রূপান্তর; ধর্মীয় মৌলবাদের আগ্রাসী রূপ; নাগরিক আবহে পাতা ঝরে পড়ার চিত্রকল্প বা নগর থেকে প্রকৃতি বিলুপ্ত হওয়ার যন্ত্রণাময় কাতরতা, কখনো ইন্দ্রিয় উদ্দিষ্ট বস্তু বা নগর সেনসেশান ইত্যাদি। যেখানে অবিমিশ্রভাবে ফুটে উঠতে থাকে ব্যক্তি জীবন থেকে প্রকৃতিকে বিচ্ছিন্ন ও বিধ্বস্ত করে ফেলার তীক্ষè যন্ত্রণাদগ্ধ ও বিচ্ছিন্ন জীবনের অপর এক বিষাদমান চিত্রকল্প।
পরবর্তী কালে এ শিল্প মানচিত্রে একে একে প্রবেশ করছে অভিঘাতী বাস্তবতার সাথে বিচিত্র শিল্পবিষয় ও বস্তুর বহুমাত্রিক বিবৃতি ও বয়ান। যেমন ধরা যাক, বড় বড় বৃক্ষের কাটাগুড়ির উপর শোভা পাচ্ছে টাব লাগানো বামন গাছ। এই এ্যাবসার্ড মিনিমাইজ প্রবণতার সাথে প্রকৃতির বিশাল অখণ্ডতাকে ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত করার দৃশ্যকল্প। কোথাও আবার উঁচু উঁচু দালানগুলো সুঁচালো ও তীক্ষè সংবেদনে বিদ্ধ করছে মাটির গভীর তলকেও। এমনকি একুরিয়ামের মতো বদ্ধতায় আধুনিক নাগরিক জীবনের ভোগবাদী বিভিন্ন অনুষঙ্গ।
এই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ‘টাইম এন্ড জার্নি’ শিরোনামে সঞ্জীবের তৃতীয় একক প্রদর্শনী আরো ভিন্ন মাত্রায় বিষয় ভাষা ও সংলাপে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। ঢাকা আর্ট সেন্টারে প্রায় ৪৫টি শিল্পকর্মের মধ্যে ২৫টি চিত্রকর্ম ও ২০টি লে-আউট ও ড্রয়িং নিয়ে এ আয়োজনে ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আঁকা ধারাবাহিক পেইন্টিংসমূহ স্থান পেয়েছে। ২০০৯ সালে আঁকা ‘টাইম এন্ড জার্নি’ সিরিজের ১১, ১২ ও ১৩ সিরিজ চিত্রকর্মত্রয়ে দেখা যায়, শিল্পীর বিষয়ী ভাবনার পরিধি উঁচু উঁচু দালান ছেড়ে নেমে আসছে নগরীর সিটি বাসের আবহে। সেখানেও দেখা যায় আমাদের রাষ্ট্র, ধর্ম ও রাজনীতির অন্ধকূপ যাত্রার বিভীষিকাময় উপাখ্যান, কিভাবে এক নৈরাজ্যিক পরিণতির দিকে ধাবমান। এসব চিত্রকর্মে দেখা যায়, বাসের চালকের আসনে বহুমাথার এক ধর্মগুরু উপবিষ্ট। অন্যদিকে বাসের আর সকল যাত্রীর বিছিন্ন মাথাগুলো চালকের পাশে ইঞ্জিনের ওপর রাখা। আর ঐ ধর্মান্ধ যাত্রীদের বিচ্ছিন্ন মাথাগুলোর জায়গায় বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের প্রতীকী ধাতবচিহ্নগুলো বসানো। এ এক অদ্ভুত অতি নাটকীয় বিকলন তথা অদৃশ্য বাস্তব ধর্ম নৈরাজ্য ও বিকলাঙ্গ পরিস্থিতি, যেখানে বিশ্বমানবতার সমস্ত অগ্রগতি ও আশার আলো নিভে যেতে পারে। সৃষ্টির সেরা জীবখ্যাত এই ধর্মান্ধ মানুষগুলো মন, প্রাণ, বিশ্বাস সব ধর্মপ্রধানের হাতে সঁপে দিয়ে নিয়তিনির্ভর এক কূপমুণ্ডক যাত্রায় সামিল হয়েছে। মাথা বিচ্ছিন্ন ব্যাপারটি এখানে অনেকটাই প্রতীকী ও ইঙ্গিতময়। বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রকলা চর্চার ধারায় এ ধরনের বুদ্ধি-বৃত্তিক ধ্যান ধারণার ভাষা ও সংলাপ ঋদ্ধ ভাবনামনস্ক চিত্রকলা দুর্লভই বলা চলে। আবার ক্যানভাসের এই ভিন্নতর চিত্রকল্পের জগৎ ছেড়ে শিল্পীর উপলব্ধির জগৎ পরিবর্তিত বাস্তবতার নিরিখে মানুষেরই দ্বারা বিধ্বস্ত দলিত প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি স্যান্ডেলের (মানুষের পায়ে পরিধেয় বস্তু বা অবজেক্ট) তলায় পিষ্ট হয়ে উঠে আসতে শুরু করে। এখানে শিল্পীর ট্রান্সফর্ম বা রূপান্তর ভাবনা ও সংবেদনশীলতার নর্ম ভিন্ন মাত্রার আবেদনে উচ্চকিত হয়ে উঠে। স্যান্ডেলের তলায় স্থানে স্থানে পেরেকবিদ্ধ তারই ওপর নদী, ফুল, মেঘ, আকাশ, চাঁদ রয়েল বেঙ্গলের চোখ সবকিছু মোহাবিষ্ট অতিনাটকীয় আলো-ছায়ায় সংলাপময় হয়ে ওঠে। প্রায় ২০১১ সাল পর্যন্ত আঁকা চিত্রকর্মগুলোতে ব্যক্তিশিল্পী ও তার ভেতর ও বাইরের বিষয়ী ভাবনার পরিমণ্ডলের সাথে বাইরের ধেঁয়ে আসা আগন্তুক বাস্তবতার সংঘাত ও সম্পর্কের বহুমাত্রিক ইতিবৃত্ত প্রতিফলিত হয়।
কিন্তু সাম্প্রতিকালে আঁকা চিত্রকর্মগুলোতে সঞ্জীবের শিল্পগন্তব্য বাইরের আগন্তুক বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে নিজেরই অন্তরীক্ষে প্রবেশে উদ্ধত হয়। দ্রুত ধাবমান সময়ের সমস্ত বিকলাঙ্গ ও দলিত উপাদনকে ভাবনায় বা উপলব্ধিতে সংকরায়িত করে ভেতর থেকে আরো ভেতরে নিমজ্জমান ও অদৃশ্য বাস্তব অথচ চরম স্যাডিস্টিক অন্তর্ঘাত প্রবণতার দায় শিল্পীর একার নয়। হয়তো শিল্পী এখানে সমাজ ও জনপদের নিগূঢ় প্রতিনিধিত্বমূলক সত্তায় রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে। কেননা ভয়াবহভাবে কোণঠাসা সহজাত সকল মানবিক বৃত্তিÑ তথা শিল্পীর যাপিত জীবনের স্মৃতি অনুষঙ্গ, গহীন অবচেতন যে আÍবিচ্ছিন্নতার উল্লাসে মত্ত বা চরম বিষণœতামগ্ন হয়ে পড়ছে; বস্তুতপক্ষে তা যেমন রূপকে শিকার জনপদের বিকলাঙ্গ ও বিকৃত অগ্রগতির প্রতিভাষ তেমনি পরোক্ষভাবে ব্যক্তি ও জনপদের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব শঙ্কাজনক রূপকথার মতো, যেটি পরা ও উত্তর-বাস্তব পরিবেষ্টিত বিকল্প এক প্রতিক্রিয়াশীল বাস্তবতা হিসেবেই প্রতিস্থাপিত। সেই সূত্রে শিল্পীর ব্যক্তিগত একাকীত্ব বিচ্ছিন্নতাবোধ, উপলব্ধির মানচিত্রে আÍিক, দৈহিক ও ভৌগোলিক পরিক্রমা ঐ জনপদের সার্বিক অস্তিত্বকল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একাকার হয়ে যায়। অথবা শিল্পী তার পার্সন বা ব্যক্তিকল্পের ভেতরেই ধারণ করেন জনপদের চেতন-অবচেতনের ভাইব্রেশনকে।
এছাড়া ‘টাইম এন্ড জার্নি’ ১৮, ১৯, ২০, ২১ ও ২৪ শীর্ষক শিল্পকর্মে শিল্পীর উপলব্ধির জগৎ ও অভিজ্ঞতার এমন রোমহর্ষক মেরুকরণ ঘটে যা আমাদের চিরচেনা যাপিত জীবন, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎকে আর্বজনার আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়ার মতো। ‘টাইম এন্ড জার্নি ১৯’ চিত্রকর্মে দেখা যায় নগ্ন এক মানবদেহ নিজের বিচ্ছিন্ন মাথাটি বেসিনের টেপের জলে ধৌত করছে। নির্মমতা ও ক্লান্তির চরম সীমা পেরুনো এই অ্যাবসার্ড চিত্রকল্প এমন এক ভয়াবহতাকে দর্শকের ভাবনায় ছুড়ে দেয়, যেখানে শিল্পীর একান্ত উপলব্ধির অভিবার্তা অকপটে বিবৃত ফিকশনের মতো তোলপাড় করে। এ ধারায় ‘জার্নি-২৪’ শীর্ষক চিত্রকর্মটি শিল্পী সঞ্জীব বড়–ুুযার এ তৃতীয় একক প্রদর্শনীর যেমন প্রধান ও প্রতিনিধিত্বশীল শিল্পকর্ম তেমনি ধারণাগত তথা গভীরতর উপলব্ধি ও বোধ সচেতন এ ধারাবাহিক শিল্পযজ্ঞের সবচেয়ে গুরুত্ববহ ও প্রায় চূড়ান্ত পরিপূরক এক ম্যানাসক্রিপ্ট বলা চলে।
চারপাশের জীবনানুষঙ্গী বস্তু ও টুলস্ নিয়ে বিছানার চাদর মুড়ি দেয়া ঘুমন্ত অবয়বের ওপর যে কংক্রিট-বাস্তব নাটকীয় প্রতিফলন ও ইলাস্ট্রেশন করা হয়েছে তা হয়তো শিল্পীর সংবেদনী নর্ম ও অভিজ্ঞতার পরোক্ষ উপাত্ত। সেখানে ব্যক্তির বা নাগরিকের কোনো রিলিফ বা মুক্তি নেই। ঐ চাদরের ওপর আগন্তুক বাস্তবতার অশনি উল্লাস বিষাক্ত সাপের মতো যেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে, তেমনি চাদরের ওপর টিকটিকি, ছারপোকা, তেলাপোকার এলোমেলো বিচরণ যাপিত জীবনের ক্লেদাক্ত ভরা ও বস্তুহারা নিঃসঙ্গ নির্বোধ জীবন সমস্ত মানবিক ঐশ্বর্যবিচ্যূত। এই বিপর্যয়ী ও ক্রীড়নক বাস্তবতাসমষ্টির ছোবলে ব্যক্তির অবিশিষ্ট ন্যূনতম স্থান নিজস্বতা ও বেঁচে থাকার স্বভাবিকতাটুকুও বিকলিত বা কলাপস্ হয়ে পড়ছে। এমনকি বিছানাটিও যেন প্রকৃতির বা ঘাসের চাদর যার অতল হতে গজিয়ে উঠছে সুতীক্ষè কালো পেরেক। ফলত এই সন্ত্রস্তপূর্ণ আবহে মনুষ্যত্ব এমনকি যাপিত মানববৃত্তি, ছন্দ বা নিজস্বতা হারিয়ে একুরিয়ামের মাছ বা কাঁচের জারে আবদ্ধ কীটপতঙ্গের মতো প্রায় বোধশক্তিহীন পরাধীন জীবসত্তায় রূপান্তরিত হয়ে চলেছে। এই ইঙ্গিতের ভেতর দিয়ে আরো এক ডিসকোর্স পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তা হলোÑ কংক্রিট ও ধাতবে নির্মিতব্য নিজেদের ফাঁদেই ব্যক্তি তথা মানবতা ও মানবসত্তার চরম পতন অনিবার্য রূপ ধারণ করছে।
‘জার্নি-২১’ শীর্ষক এই চিত্রে দেখা যায়, কাটা বৃক্ষের সারিবদ্ধ গুড়িসমূহ পেরেক মারা বাক্সে বন্দি। হয়তো ঐ কর্তিত বৃক্ষের কাঠে বানানো বাক্সে বন্দিত্ব বরণ করেছে শিল্পীর অর্ন্তব্যক্তিক উৎস ও তার চারপাশ। এ ধারায় আরেকটি চিত্রকর্ম হলো, জালে আটকানো মুরগীর খাঁচার ওপর উঁচু উঁচু দালানের নগর চিত্রকল্প। মানুষগুলো মুরগী রূপকে হয়তো চরম বৈষম্যে বিপর্যস্ত কিংবা নিগৃহীত ব্যক্তিসত্তার আরেক সংবেদনশীল শিকার ও ভোগ্যপণ্য রূপ। ক্রুর বাস্তবতার গভীরতাকে পরিমাপের জন্য সময় ও বাস্তবতার সমস্ত সীমাকে ডিঙিয়ে, ছাপিয়ে বিকল্প কোনো এক বাস্তবতাকে নাটকীয় বিভ্রমের মতো দর্শকের সম্মুখে হাজির করেছেন শিল্পী সঞ্জীব বড়–য়া। ক্যানভাসের দৃশ্যস্তর সংশ্লিষ্ট বিষয় কিংবা শিল্পীর বিষয়কে উপস্থাপনের ধরনটা যদি দর্শকের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, তবে শিল্পীর ধারণা ও উপলব্ধির উৎস, রূপান্তরকীর্তি বুদ্ধি বৃত্তির ধরন ও নাটকীয় চিত্রকল্প ব্যঞ্জনার এসব সমকালীন শিল্প নন্দনতত্ত্ব বা টার্ম থেকেও তারা বঞ্চিত হবেন।
শিল্পীর ব্যক্তিগত উপলদ্ধি ও অভিজ্ঞতার অভিঘাত কিংবা অভ্যন্তরীণ অভিশংসনের পথ পরিক্রমা সময়ের সাথে বাস্তবের রূপ ভাষা ও বৌদ্ধিকতার স্তর পাল্টে যে চরম বিচ্ছিন্নতাদগ্ধ ও নিস্তব্ধ নগর মহাকাব্যিক পরিমণ্ডল উš§ুক্ত করে চলেছেÑ তা সমকালীন শিল্পভাষারই এক গুরুত্বপুর্ণ অনুষঙ্গ বা দলিল। শিলীগু আগন্তুক বাস্তবতাকে থ্রিল ও হরর রূপকথার মতো ক্যানভাসে বিবৃত করতে করতে; প্রকৃতি ও বাস্তুচ্যূত অথবা উৎসহীন জীবনের খণ্ডিত চেতন বা অবচেতন সত্তাকে গভীর খাদে নিপতিত করে চলেছেন। ক্যানভাসের এ আপাত ব্যক্তির নেতিঘাতপ্রবণ দৃশ্য বা অদৃশ্যমান বাস্তবতা হয়তো শিল্পীর অভিনব রিপ্রেজেন্টেশন বা নাটকীয় উপস্থাপনারই নামান্তর। যেটি তরুণ বাঙালি শিল্পীদের মাঝে খুব একটা দেখা যায়নি। আরো কৌতূহলের ব্যাপার হচ্ছে, সমকালীন চিত্রকলার করণ-কৌশল ও নির্মাণ বা কারিগরী বৈশিষ্ট্যের স্বাভাবিক ছন্দকে এড়িয়ে গিয়ে চেতনে-অচেতনে অনেক ক্ষেত্রে তুলি ও রঙ জাতীয় মাধ্যমসমূহ, শিল্পীর উপলব্ধির মানচিত্রে তথা ক্যানভাসে বৈচিত্র্যময় সব চিত্রকল্প বিনির্মাণের টুলস বা উপাদানে পরিণত হয়। এমনকি লাল-নীল ছাড়াও সাদা, মেজেন্টা গোলাপি, সবুজ ও হলুদ সমস্ত মৌলিক-অমৌলিক রঙকে ধূসরতায় মুড়ে নিজস্ব একটা প্রোটোটাইপ ও স্টাইল সৃজন করা হয়, যা শিল্পীর ভাবনার নর্ম, নাটকীয় আবহ ও বুদ্ধিবৃত্তির মাত্রাকে ভিন্নভাবে উচ্চকিত করে। এছাড়া শিকার ও সংক্রামিত অস্তিত্বের ভেতরকার অভিব্যক্তি বা নেতি প্রবণতা, শিল্পীর যাপিত সময়ের নানামুখী বৌদ্ধিক সমীক্ষণ তথা আধুনিকোত্তর ধারণাকল্পের শিল্পাবেদন ছাড়াও দর্শকের সš§ুখে উৎকণ্ঠা ও শঙ্কার পাশাপাশি এর পরিণতি সচেতনতার সংলাপী অধিবার্তাও তুলে ধরে।
‘টাইম এন্ড জার্নি’ শীর্ষক আয়োজন- শিল্পী সঞ্জীব বড়–য়ার এই বিকল্প বাস্তবের ধারণাঋদ্ধ অন্তর্পরিক্রমার ডায়েরি আশা করি, বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পতীর্থে ভিন্ন ধারার শিল্পরসদ ও আবেদন যোগাতে সক্ষম হবে। সূত্র : নতুন ধারা 

এই বিভাগে আরো আছে

চিত্র শিল্পী 6654477776735179693

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সঙ্গে থাকুন

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক

বৈশিষ্ট্যযুক্ত

বিশ্বসেরা ১০ কার্টুনিস্ট

শিল্পী রফিকুননবী সাধারণ মানুষের কাছে যতটা না তার ফাইন আর্টসের জন্য পরিচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় তার ‘টোকাই’ কার্টুন চরিত্রের জন্য। এ ...

-

  • ফেসবুকে অনুসরণ করুন

    আঁকা-আঁকি আহ্ববান

    আপনার আঁকা, মজার মজার লেখা, ছবি আঁকার কলা-কৌশল, শিল্পীর জীবনী, প্রবন্ধ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অথবা প্রদর্শনীর সংবাদ টুনস ম্যাগে ছাপাতে চাইলে পাঠিয়ে দিন। আমাদের ইমেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।

    সহায়তা করুন

    item