চিত্রশিল্প সারা জীবনের সাধনার ব্যাপার : হামিদুজ্জামান খান
বিডি.টুনসম্যাগ.কম আমার জন্ম গ্রামে। বাড়ির পাশেই ছিল শিল্পী হেমেন মজুমদারের বাড়ি। তাঁর অনেক গল্প শুনেছি বাবার মুখে, একজন অনেক বড় শিল্পী।...
https://bd.toonsmag.com/2015/06/301006.html
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
আমার জন্ম গ্রামে। বাড়ির পাশেই ছিল শিল্পী হেমেন মজুমদারের বাড়ি। তাঁর অনেক গল্প শুনেছি বাবার মুখে, একজন অনেক বড় শিল্পী। মারা গেছেন সম্ভবত ১৯৪০ সালের দিকে। তাঁর বাড়িটা আমি দেখতাম। বাড়িটা ছিল একটু অন্যরকম। সাধারণ টিনের বাড়ি, কিন্তু অন্যরকম। সমগ্র ভারত তাঁকে চিনত, তারপর অনেক দেশ ঘুরেছেন, অনেক খ্যাতি। এটা ছিল আমার কাছে একটা অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি আমি ছোটবেলা থেকেই একটু একটু ছবি আঁকতাম। অনেকে আমাকে ডেকে নিয়ে যেত ছবি এঁকে দেওয়ার জন্য। বলত যে আমার দাদার ছবি এঁকে দাও, আমাদের মসজিদের ছবি এঁকে দাও। এ রকম অনেকের ছবি এঁকে দিতাম। তখন ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি। বাড়ির কাছেই ছিল স্কুল। বনগ্রাম হাই স্কুল। স্কুলের শিক্ষকরা ছিলেন অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাঁরা দেশ-বিদেশের একটু খোঁজখবর রাখতেন। তাঁদের কাছে ভারত থেকে পত্রপত্রিকা আসত। দেশ পত্রিকা আসত। আমাকে অনেক ছবি দেখাতেন। এসব ছবি দেখেও আমার ভেতর অনুপ্রেরণা জন্মে। হয়তো ভূগোল পরীক্ষা দিচ্ছি, ছবি এঁকে ভরে ফেলেছি, অনেক ড্রইংট্রয়িং করে দিতাম। এভাবে ছাত্রজীবনেই ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক। তারপর ম্যাট্রিক পাস করলাম। ঠিক জানতাম না, চারুকলা কোথায় কী! গ্রামেই বড় হয়েছি। চারুকলায় যেতে হলে কোথায় যাব, কিভাবে যাব-এসব কোনো কিছুই জানতাম না। চারুকলা সম্পর্কে জানলাম আমাদের এক পোস্ট মাস্টারের কাছে। উনি বললেন, চারুকলা আছে, আপনি ইচ্ছে করলে পড়তে পারেন। পরে আমি ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলাম সায়েন্স নিয়ে। কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না। তখন খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম, ঢাকা গিয়ে কিভাবে চারুকলায় পড়া যায়। বাবাকে বললাম, আমাকে চারুকলায় নিয়ে যান। আমি চারুকলায় পড়তে চাই। শেষ পর্যন্ত আমি জয়ী হলাম, বাবা রাজি হলেন। তিনি আমাকে ঢাকায় জয়নুল আবেদিন স্যারের বাসায় নিয়ে গেলেন। আবেদিন স্যারের সঙ্গে দেখা হলো। সঙ্গে নিজের করা কিছু ড্রয়িং নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার ড্রয়িংগুলো দেখলেন। বললেন, তুমি পাস করছ, যাও ভর্তি হও। সেই যে ভর্তি হয়ে গেলাম, এখনো লেগে আছি। আমি পাস করেছি পেইন্টিং থেকে। চারুকলার প্রথম দিকে তো আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্ট ছিল না। প্রথম ডিপার্টমেন্ট শুরু হয় সম্ভবত ১৯৬৩ সালের দিকে। প্রথমে চারটা ডিপার্টমেন্ট হয়। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
এখন চারুকলা অনেক জনপ্রিয়। এখন ভালো ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে। আগে তো আসত পড়াশোনায় ভালো না, হয়তো ক্যারিয়ারে এত বেশি ভালো ছিল না-এ রকম ছাত্ররা। এখন চারুকলা থেকে পাস করে কোনো কিছু করতে পারে। কাজের অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
আসলে আর্ট একটা সাধনার ব্যাপার। কঠিন জিনিস। এতে প্রবেশ করে সারা জীবন এটা নিয়েই থাকতে হবে। অন্য ক্ষেত্রে দেখা যায় ডিগ্রি হয়ে গেলে একটা চাকরি পাওয়া যায়, আর কিছু প্রয়োজন হয় না, চাকরি করছে। তবে চারুকলায় কিন্তু শুধু ডিগ্রি হলেই লাভ নেই। এটাকে বহন করে নিয়ে যেতে হবে। এটা নিয়েই থাকতে হবে। সারাটা জীবনই থাকতে হবে। এটা একটা কঠিন পেশা, মানে লেগে থাকতে হবে। যারা লেগে আছে, তারাই টিকে আছে। আমরা দেখেছি পড়েছে হয়তো পঞ্চাশ জন, এর মধ্যে পাস করেছে ৩৫-৪০ জন। কিন্তু এর সবাই তো আর শিল্পী হয় না। অনেকে অনেক দিকে চলে যায়। আবার দেখা যায় কেউ কেউ আর্টেরই অন্য লাইনে চলে গেছে। সঠিক লাইনে হয়তো কমই থাকে। এটা অবশ্য সব ক্ষেত্রেই আছে। আমি বলব, যদি লেগে থাকে তবে অবশ্যই ফল পাবে। এটা আমাদেরও লাভ, দেশের জন্যও লাভ। এত বাধাবিপত্তির মধ্যেও কিন্তু আজ চারুকলা অনেক এগিয়ে। আমাদের অনেক বড় শিল্পী তৈরি হচ্ছে। নতুনরাও ভালো কাজ করছে। আমার মনে হয়, চারুকলার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। পাশাপাশি শিল্পকলা অনেক বড় হয়েছে। অনেক এভিনিউ তৈরি হয়েছে, যার ফলে চর্চাটাও ভালোভাবে করতে পারছে। এখন যারা ছবি আঁকে, তাদের তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। সব কিছু মিলিয়ে চারুকলা একটা ভালো দিকে যাচ্ছে। এটা একটা শুভ লক্ষণ। দৈনিক কালের কন্ঠতে প্রকাশিত
শ্রুতলিখন : চন্দন চৌধুরী
আমার জন্ম গ্রামে। বাড়ির পাশেই ছিল শিল্পী হেমেন মজুমদারের বাড়ি। তাঁর অনেক গল্প শুনেছি বাবার মুখে, একজন অনেক বড় শিল্পী। মারা গেছেন সম্ভবত ১৯৪০ সালের দিকে। তাঁর বাড়িটা আমি দেখতাম। বাড়িটা ছিল একটু অন্যরকম। সাধারণ টিনের বাড়ি, কিন্তু অন্যরকম। সমগ্র ভারত তাঁকে চিনত, তারপর অনেক দেশ ঘুরেছেন, অনেক খ্যাতি। এটা ছিল আমার কাছে একটা অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি আমি ছোটবেলা থেকেই একটু একটু ছবি আঁকতাম। অনেকে আমাকে ডেকে নিয়ে যেত ছবি এঁকে দেওয়ার জন্য। বলত যে আমার দাদার ছবি এঁকে দাও, আমাদের মসজিদের ছবি এঁকে দাও। এ রকম অনেকের ছবি এঁকে দিতাম। তখন ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি। বাড়ির কাছেই ছিল স্কুল। বনগ্রাম হাই স্কুল। স্কুলের শিক্ষকরা ছিলেন অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাঁরা দেশ-বিদেশের একটু খোঁজখবর রাখতেন। তাঁদের কাছে ভারত থেকে পত্রপত্রিকা আসত। দেশ পত্রিকা আসত। আমাকে অনেক ছবি দেখাতেন। এসব ছবি দেখেও আমার ভেতর অনুপ্রেরণা জন্মে। হয়তো ভূগোল পরীক্ষা দিচ্ছি, ছবি এঁকে ভরে ফেলেছি, অনেক ড্রইংট্রয়িং করে দিতাম। এভাবে ছাত্রজীবনেই ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক। তারপর ম্যাট্রিক পাস করলাম। ঠিক জানতাম না, চারুকলা কোথায় কী! গ্রামেই বড় হয়েছি। চারুকলায় যেতে হলে কোথায় যাব, কিভাবে যাব-এসব কোনো কিছুই জানতাম না। চারুকলা সম্পর্কে জানলাম আমাদের এক পোস্ট মাস্টারের কাছে। উনি বললেন, চারুকলা আছে, আপনি ইচ্ছে করলে পড়তে পারেন। পরে আমি ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলাম সায়েন্স নিয়ে। কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না। তখন খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম, ঢাকা গিয়ে কিভাবে চারুকলায় পড়া যায়। বাবাকে বললাম, আমাকে চারুকলায় নিয়ে যান। আমি চারুকলায় পড়তে চাই। শেষ পর্যন্ত আমি জয়ী হলাম, বাবা রাজি হলেন। তিনি আমাকে ঢাকায় জয়নুল আবেদিন স্যারের বাসায় নিয়ে গেলেন। আবেদিন স্যারের সঙ্গে দেখা হলো। সঙ্গে নিজের করা কিছু ড্রয়িং নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার ড্রয়িংগুলো দেখলেন। বললেন, তুমি পাস করছ, যাও ভর্তি হও। সেই যে ভর্তি হয়ে গেলাম, এখনো লেগে আছি। আমি পাস করেছি পেইন্টিং থেকে। চারুকলার প্রথম দিকে তো আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্ট ছিল না। প্রথম ডিপার্টমেন্ট শুরু হয় সম্ভবত ১৯৬৩ সালের দিকে। প্রথমে চারটা ডিপার্টমেন্ট হয়। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
এখন চারুকলা অনেক জনপ্রিয়। এখন ভালো ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে। আগে তো আসত পড়াশোনায় ভালো না, হয়তো ক্যারিয়ারে এত বেশি ভালো ছিল না-এ রকম ছাত্ররা। এখন চারুকলা থেকে পাস করে কোনো কিছু করতে পারে। কাজের অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
আসলে আর্ট একটা সাধনার ব্যাপার। কঠিন জিনিস। এতে প্রবেশ করে সারা জীবন এটা নিয়েই থাকতে হবে। অন্য ক্ষেত্রে দেখা যায় ডিগ্রি হয়ে গেলে একটা চাকরি পাওয়া যায়, আর কিছু প্রয়োজন হয় না, চাকরি করছে। তবে চারুকলায় কিন্তু শুধু ডিগ্রি হলেই লাভ নেই। এটাকে বহন করে নিয়ে যেতে হবে। এটা নিয়েই থাকতে হবে। সারাটা জীবনই থাকতে হবে। এটা একটা কঠিন পেশা, মানে লেগে থাকতে হবে। যারা লেগে আছে, তারাই টিকে আছে। আমরা দেখেছি পড়েছে হয়তো পঞ্চাশ জন, এর মধ্যে পাস করেছে ৩৫-৪০ জন। কিন্তু এর সবাই তো আর শিল্পী হয় না। অনেকে অনেক দিকে চলে যায়। আবার দেখা যায় কেউ কেউ আর্টেরই অন্য লাইনে চলে গেছে। সঠিক লাইনে হয়তো কমই থাকে। এটা অবশ্য সব ক্ষেত্রেই আছে। আমি বলব, যদি লেগে থাকে তবে অবশ্যই ফল পাবে। এটা আমাদেরও লাভ, দেশের জন্যও লাভ। এত বাধাবিপত্তির মধ্যেও কিন্তু আজ চারুকলা অনেক এগিয়ে। আমাদের অনেক বড় শিল্পী তৈরি হচ্ছে। নতুনরাও ভালো কাজ করছে। আমার মনে হয়, চারুকলার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। পাশাপাশি শিল্পকলা অনেক বড় হয়েছে। অনেক এভিনিউ তৈরি হয়েছে, যার ফলে চর্চাটাও ভালোভাবে করতে পারছে। এখন যারা ছবি আঁকে, তাদের তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। সব কিছু মিলিয়ে চারুকলা একটা ভালো দিকে যাচ্ছে। এটা একটা শুভ লক্ষণ। দৈনিক কালের কন্ঠতে প্রকাশিত
শ্রুতলিখন : চন্দন চৌধুরী