নববর্ষের প্রথম দিনে ডাকাত হওয়ার স্মৃতি
রফিকুল ইসলাম সাগর বিডি.টুনসম্যাগ.কম ছোটবেলা থেকেই আমি বাউণ্ডুলে স্বভাবের এবং ভ্রমন প্রিয়। বরাবরই বিশেষ দিন মানেই আমার বিশেষ আয়োজন। ক...

https://bd.toonsmag.com/2015/04/14305.html
রফিকুল ইসলাম সাগর
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
ছোটবেলা থেকেই আমি বাউণ্ডুলে স্বভাবের এবং ভ্রমন প্রিয়। বরাবরই বিশেষ দিন মানেই আমার বিশেষ আয়োজন। কয়েক বছর বছর আগের কথা। সেবার বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছিলাম পহেলা বৈশাখে কোথাও যাবো।
একমাস আগেই আমরা আট বন্ধু ঠিক করেছিলাম চট্টগ্রাম যাবো। বন্ধু পাভেল চট্টগ্রামে সি-ফিল নামক একটি জায়গায় ঘুরে এসে আমাদের কাছে সেই জায়গা সম্পর্কে বর্ণনা করেছিল। তারপর থেকেই সেখানে যাওয়ার ভূত আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে। একমাস আগে থেকেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল। প্রতিদিন আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল বৈশাখের প্রথম দিনে চট্টগ্রাম ভ্রমন, কিভাবে কী হবে! রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারতাম না। চোখ বন্ধ হলে চলে যেতাম সি-ফিল বিচে।
কিন্তু পহেলা বৈশাখের আগে আমার প্রচণ্ড জ্বর এলো। বন্ধুরা আমায় দেখে বলল, জ্বর হলেও আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। আমারও আপত্তি নেই। মন বলছিলো, প্রকৃতির সান্নিধ্য পেলে আমার অসুখ দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বাবা-মায়ের আপত্তি, তারা এই অবস্থায় আমাকে যেতে দিতে রাজি না। আমিও নাছোড়বান্দা, যেতে আমাকে হবেই। বাড়ির সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্যাগে কাপড় গোছালাম।
চৈত্রের শেষ দিন সকাল ১১টায় কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে পরলাম। বন্ধুরা একত্রিত হলাম। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে বাসে উঠে আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছলাম। চট্টগ্রামে গিয়ে টার্মিনাল থেকে অটোরিক্সায় ১৫ নম্বর ঘাটে গেলাম। এটি চট্টগ্রাম বন্দরেরই অংশ। বন্দরে ছোট বড় দেশি-বিদেশি জাহাজ দেখতে পেলাম। ঘাটের পাথরের উপরে কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম। সমুদ্রের ঢেউ এসে পাথরে আছড়ে পড়ছিল।
এবার ১৫ নম্বর ঘাট থেকে নৌকায় উঠলাম। নৌকা থেকে নেমে আবার অটোরিক্সা। অবশেষে পৌঁছলাম সেই বিচের কাছে। পাকা সড়ক থেকে মাটির পথ হেটে একটু সামনে গিয়েই দেখলাম সমুদ্রের গর্জন আমাদের ডাকছে। তখন প্রায় সন্ধ্যা। বিচের পাশে কিছু টং-দোকান। জানতে পারলাম দোকান গুলো সন্ধা ৭টায় বন্ধ হয়ে যাবে। আর আশপাশে থাকার জন্য কোনো আবাসিক হোটেলের ব্যবস্থা নেই। আমাদেরকে বিচে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করতে হবে।
আমরা টং-দোকান গুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে আমাদের যার যার প্রয়োজন মতো শুকনা খাবার কিনে রাখলাম। দোকান গুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চারিদিক পুরো নিরব হয়ে গেলো। আমরা আটজন ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। শুধু কয়েকটি কুকুর দেখতে পেয়েছিলাম। রাত যতো গভীর হচ্ছিল পরিবেশ ততো ভয়ংকর হচ্ছিল। তবে সে দিকে আমাদের কোনো খেয়াল ছিলনা। একটু দূরে নোঙর করা জাহাজ থেকে ঠিকরে বেরুনো আলো আমাদেরকে সাহস দিয়েছিল। হৈ চৈ করে জাগিয়ে রেখেছিলাম গোটা বিচ। খালি বোতলকে ফুটবল বানিয়ে পা দিয়ে কিক করে করে দৌড়াচ্ছিলাম। বালিতে গড়াগড়ি করে, একে অন্যকে বালি ছেড়াছুড়ি করে ক্লান্ত শরীর নিয়েই মধ্যরাতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সমুদ্রের বুকে। সমুদ্রে ঝাঁপাঝাঁপি করে শরীর আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ল। হঠাৎ আমাদের মাঝে রনিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
আমরা সবাই খুব ভয় পেয়ে গেলাম। রনি....রনি.... চিত্কার করে খুঁজতে শুরু করলাম। রনি কোনো উত্তর দিচ্ছে না। চারিদিকে অন্ধকার। রনিকে খুঁজে না পেয়ে আজে বাজে চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাওয়া শুরু হলো।
অবশেষে দেখলাম রনি বিচের এক স্থানে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। রনিকে দুইজন মিলে তুলে নিয়ে এসে ঝাউ বনের ভিতর আশ্রয় নিলাম। শেষ পর্যন্ত আর আমিও জেগে থাকতে পারলাম না। ভোর হওয়ার আগে বালিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘণ্টাখানেক পরেই নতুন বছরের প্রথম আলোতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সকাল হতেই পেটে নাড়া পড়ল। প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঝাউ বনের পাশে একটি টয়লেটের কাছে লাইন ধরলাম। টয়লেটে একজন ঢুকছে অন্যরা বাইরে বসে তার বের হওয়ার অপেক্ষায় টয়লেটের দরজার দিকে তাকিয়ে।
তারপর এই বিচ ছেড়ে যখন আমরা কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম তখন বাসের ভিতর সবাই আমাদের দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। কক্সবাজার পৌঁছে যখন আয়নায় নিজের চেহারা দেখলাম নিজেকে ডাকাতের মতো দেখাচ্ছিল। তখন বুঝলাম, বাসের ভেতর সবাই আমাদের দিকে ওভাবে তাকাচ্ছিলো কেন!
লেখক : সম্পাদক টুনসম্যাগ (বাংলা)।
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
একমাস আগেই আমরা আট বন্ধু ঠিক করেছিলাম চট্টগ্রাম যাবো। বন্ধু পাভেল চট্টগ্রামে সি-ফিল নামক একটি জায়গায় ঘুরে এসে আমাদের কাছে সেই জায়গা সম্পর্কে বর্ণনা করেছিল। তারপর থেকেই সেখানে যাওয়ার ভূত আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে। একমাস আগে থেকেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল। প্রতিদিন আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল বৈশাখের প্রথম দিনে চট্টগ্রাম ভ্রমন, কিভাবে কী হবে! রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারতাম না। চোখ বন্ধ হলে চলে যেতাম সি-ফিল বিচে।
কিন্তু পহেলা বৈশাখের আগে আমার প্রচণ্ড জ্বর এলো। বন্ধুরা আমায় দেখে বলল, জ্বর হলেও আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। আমারও আপত্তি নেই। মন বলছিলো, প্রকৃতির সান্নিধ্য পেলে আমার অসুখ দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বাবা-মায়ের আপত্তি, তারা এই অবস্থায় আমাকে যেতে দিতে রাজি না। আমিও নাছোড়বান্দা, যেতে আমাকে হবেই। বাড়ির সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্যাগে কাপড় গোছালাম।
চৈত্রের শেষ দিন সকাল ১১টায় কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে পরলাম। বন্ধুরা একত্রিত হলাম। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে বাসে উঠে আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছলাম। চট্টগ্রামে গিয়ে টার্মিনাল থেকে অটোরিক্সায় ১৫ নম্বর ঘাটে গেলাম। এটি চট্টগ্রাম বন্দরেরই অংশ। বন্দরে ছোট বড় দেশি-বিদেশি জাহাজ দেখতে পেলাম। ঘাটের পাথরের উপরে কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম। সমুদ্রের ঢেউ এসে পাথরে আছড়ে পড়ছিল।
এবার ১৫ নম্বর ঘাট থেকে নৌকায় উঠলাম। নৌকা থেকে নেমে আবার অটোরিক্সা। অবশেষে পৌঁছলাম সেই বিচের কাছে। পাকা সড়ক থেকে মাটির পথ হেটে একটু সামনে গিয়েই দেখলাম সমুদ্রের গর্জন আমাদের ডাকছে। তখন প্রায় সন্ধ্যা। বিচের পাশে কিছু টং-দোকান। জানতে পারলাম দোকান গুলো সন্ধা ৭টায় বন্ধ হয়ে যাবে। আর আশপাশে থাকার জন্য কোনো আবাসিক হোটেলের ব্যবস্থা নেই। আমাদেরকে বিচে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করতে হবে।
আমরা টং-দোকান গুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে আমাদের যার যার প্রয়োজন মতো শুকনা খাবার কিনে রাখলাম। দোকান গুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চারিদিক পুরো নিরব হয়ে গেলো। আমরা আটজন ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। শুধু কয়েকটি কুকুর দেখতে পেয়েছিলাম। রাত যতো গভীর হচ্ছিল পরিবেশ ততো ভয়ংকর হচ্ছিল। তবে সে দিকে আমাদের কোনো খেয়াল ছিলনা। একটু দূরে নোঙর করা জাহাজ থেকে ঠিকরে বেরুনো আলো আমাদেরকে সাহস দিয়েছিল। হৈ চৈ করে জাগিয়ে রেখেছিলাম গোটা বিচ। খালি বোতলকে ফুটবল বানিয়ে পা দিয়ে কিক করে করে দৌড়াচ্ছিলাম। বালিতে গড়াগড়ি করে, একে অন্যকে বালি ছেড়াছুড়ি করে ক্লান্ত শরীর নিয়েই মধ্যরাতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সমুদ্রের বুকে। সমুদ্রে ঝাঁপাঝাঁপি করে শরীর আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ল। হঠাৎ আমাদের মাঝে রনিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
আমরা সবাই খুব ভয় পেয়ে গেলাম। রনি....রনি.... চিত্কার করে খুঁজতে শুরু করলাম। রনি কোনো উত্তর দিচ্ছে না। চারিদিকে অন্ধকার। রনিকে খুঁজে না পেয়ে আজে বাজে চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাওয়া শুরু হলো।
অবশেষে দেখলাম রনি বিচের এক স্থানে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। রনিকে দুইজন মিলে তুলে নিয়ে এসে ঝাউ বনের ভিতর আশ্রয় নিলাম। শেষ পর্যন্ত আর আমিও জেগে থাকতে পারলাম না। ভোর হওয়ার আগে বালিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘণ্টাখানেক পরেই নতুন বছরের প্রথম আলোতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সকাল হতেই পেটে নাড়া পড়ল। প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঝাউ বনের পাশে একটি টয়লেটের কাছে লাইন ধরলাম। টয়লেটে একজন ঢুকছে অন্যরা বাইরে বসে তার বের হওয়ার অপেক্ষায় টয়লেটের দরজার দিকে তাকিয়ে।
তারপর এই বিচ ছেড়ে যখন আমরা কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম তখন বাসের ভিতর সবাই আমাদের দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। কক্সবাজার পৌঁছে যখন আয়নায় নিজের চেহারা দেখলাম নিজেকে ডাকাতের মতো দেখাচ্ছিল। তখন বুঝলাম, বাসের ভেতর সবাই আমাদের দিকে ওভাবে তাকাচ্ছিলো কেন!
লেখক : সম্পাদক টুনসম্যাগ (বাংলা)।