যাপিত জীবনে শিল্পীর দহন

খান মিজান বিডি.টুনসম্যাগ.কম প্রদর্শনী -  -   টাইম অব নেচার ১ যেকোনো শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শিল্পীর নিজস্ব জীবন ও বিশ্বাস। জী...

খান মিজান
বিডি.টুনসম্যাগ.কম

প্রদর্শনী -  -  
টাইম অব নেচার ১

যেকোনো শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শিল্পীর নিজস্ব জীবন ও বিশ্বাস। জীবন ও বিশ্বাস তৈরি হয় সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের ভেতর দিয়ে। সুতরাং শিল্পকর্ম অবলোকনের সময় সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলির ভেতর দিয়ে শিল্পীর লব্ধ দার্শনিক ও নন্দনতাত্ত্বিক উপলব্ধি শিল্পের পাঠক মাত্রই জানা প্রয়োজন। এতে ওই শিল্পীর শিল্পরীতি ও উদ্দেশ্যও অনেকটা ধরা পড়ে। শিল্পী কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো অনেক বেশি প্রযোজ্য। রাজধানীর শিল্পাঙ্গনে চলছে এই শিল্পীর একক চিত্রকর্মের প্রদর্শনী। সেখানে প্রদর্শিত চিত্রমালায় ডুব দিয়ে পাঠ করা যায় তাঁর শৈল্পিক এষণার প্রেরণা। কী সেই প্রেরণার উৎস?

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনেক শিল্পীর হাতে তুলির পরিবর্তে রাইফেল উঠেছিল। আবার সেসব আগুনঝরা দিনে অনেক শিল্পীর রং-তুলিও বন্দুকের চেয়ে শক্তিধর হয়েছিল। বারো বছরের কিশোরী কৃষ্ণার হাতে তখন রং-তুলি কিংবা বন্দুক কিছুই ছিল না। যা ছিল তা হলো দুই চোখ, দৃষ্টির সক্ষমতা আর অন্তর্গত মনোভূমি। দুই চোখে ধারণ করে সেই নিষ্ঠুর ও বিশৃঙ্খল পারিপার্শ্বিকতার ছবি তুলে রেখেছিলেন তিনি। আর ফাঁকে ফাঁকে চেষ্টা করেছেন প্রকৃতির অন্বিষ্ট অনুসন্ধান করতে।

সমাজবাস্তবতার সচেতন প্রতিফলন চিরন্তন অবয়বকে বদলে দেয়, রেখায় ও রঙে আসে বৈচিত্র্য- চিত্রবিদ্যার্থীদের কাছে এ এক সাধারণ ব্যাকরণ। কৃষ্ণার চিত্রধারায়ও এসেছে বৈচিত্র্য। ফলে তিনি যা দেখেন, তার চেয়ে বেশি মনোযোগী সেসব বিষয়ে- যা তিনি দেখেছেন অতীতে, যার স্থান হয়েছে স্মৃতির পাতায়। মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনাকে আশ্রয় করে এঁকেছেন যুদ্ধোত্তর চিত্রকলা। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আঁকিবুঁকির মধ্য থেকে নানা ঘটনার লব্ধ সৃষ্টকে বাস্তবতায় আনতে চেয়েছেন রেখায়-রঙে, যেখানে ইতিহাস ও পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার প্রত্যক্ষণ স্পষ্ট। বাহুল্যকে বর্জন করে মূল বিষয়কে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে রেখার সাবলীল টানে।

স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ নানা ঘটনার আবর্তে গড়ে ওঠা গভীর জীবনবোধ কৃষ্ণাকে পরিণত করেছে পরিপূর্ণ শিল্পীতে। একটি অনুভূতিশীল হৃদয়ের প্রতিমূর্তি যেন তিনি। তাঁর সব ছবিজুড়ে সমকালের যন্ত্রণা ও সংক্ষোভ নানাভাবে উন্মোচিত। বেশির ভাগ কাজে হালকা রঙের আভায় চিত্রতলকে রঞ্জিত করে কিংবা কালি-কলমের সাবলীল টানে বিশালতাকে তুলে ধরেন শিল্পী। যেখানে রূপের সংবেদের পরিবর্তে মুখ্য হয়ে ওঠে ভাবের সংবেদ।



ইনক্লেমেশন ৫
মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধোত্তর শিল্পকর্ম হিসেবে আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বাণিজ্য, যুদ্ধকালের প্রত্যাশার সঙ্গে যুদ্ধোত্তর সময়ের প্রাপ্তি- এসবের অনেক কিছুই প্রলুব্ধ করেছে কৃষ্ণার চিত্রচর্চার রুচির জোগান দিতে। তাঁর বেশির ভাগ চিত্রকর্ম ড্রয়িং রুমে শোভাবর্ধনের উপযোগিতা তুলে ধরে না। অভিজাত পরিবারের রুচির জোগান দিতে প্রস্তুত নন তিনি। তাঁর সব কাজজুড়ে রয়েছে দহন অন্তর্গত রক্তক্ষরণের উপকরণ- মানুষের ভয়ার্ত-বেদনার্ত মুখ, ছিন্নভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর হায়েনা কিংবা শিয়াল-কুকুরের উপদ্রব। এসব উপস্থাপনায় ক্যানভাসে নিজস্ব চিত্রভাষা তাঁর স্বকীয়তাকে তুলে ধরে।

কৃষ্ণার ভাবনার বিষয় মানুষ। চিত্রতলে অসংখ্য মানুষের মুখাবয়ব কিংবা শরীরী কাঠামো। মানুষ আর প্রকৃতিই তাঁর ধ্যানের বিষয়। হানাদার পাকিস্তানি ক্যাম্পে আনত উপবিষ্ট নারী, যৌনদাসীর মতো ব্যবহৃত নারী, উৎপাদনশীল মানুষ, সংগ্রামী মানুষ। মানুষের সমাবেশ দিয়ে তিনি তুলে ধরতে চান এই ভূখণ্ডের মানুষের লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্য। এটি করতে গিয়ে তিনি ব্যবহার করেছেন এই ভূখণ্ডের কিছু পৌরাণিক চরিত্র। এসব চরিত্রের ধূসর কাঠামোগুলো অবলীলায় ধরা দেয় তাঁর ক্যানভাসে। ক্যানভাস বলতে কাগজ; এর ওপর কলমের ধূসর কালো রেখা। মানুষকে সঙ্গে নিয়েই তিনি লড়তে চান। কেবল এ রেখা দিয়েই তাঁর শিল্পসত্ত্বার নানা রূপ নানাভাবে উপস্থাপিত।

শিল্পীর চিত্রমালায় বিমূর্তধারার কাজও রয়েছে কিছু। সেসব কাজে নিসর্গ ও মানবজীবন নানাভাবে প্রতিফলিত। ফুল, পাখি, নদী, বৃক্ষের অস্পষ্ট ফর্ম। এ কাজগুলো তিনি করেছেন রূপবাদী ধারায়। প্রচল রীতিতে বাইরে উন্মুক্ত আলোয় বস্তুসত্তার নতুন রূপের সন্ধান করেছেন তিনি। এসব কাজে তাঁর শৈল্পিক এষণা বস্তু নয়- বস্তুর বর্ণালোক বা বর্ণসত্তা। সেখানে মুহূর্তের আনন্দ-উচ্ছলতাকে কেবল বর্ণবিভায় ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস। চিত্রতলের বর্ণবৈভবে লুকিয়ে থাকে প্রকৃতি, জীবন, ইতিহাস আর মানুষের জীবন সহযোগী নানা অনুষঙ্গ।

কৃষ্ণার সমগ্র চিত্রমালা দেখে এ কথা বলা যায়, ক্যানভাসে নিসর্গের রূপান্বেষই প্রিয় বিষয় হিসেবে তুলে ধরতে চান তিনি। মাটি ও মানুষ, মানুষ ও প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের বাঁধন সেখানে। তবে প্রেতমানুষের কবলে পড়ে প্রকৃতির কাছে আশ্রয় নেওয়ার পক্ষে তিনি নন। এ ক্ষেত্রে দানবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পক্ষপাতী তিনি। তাঁর ড্রয়িংনির্ভর কাজগুলোতে তীব্র ফ্যান্টাসি কিংবা অ্যাবসার্ড ভাবনার মধ্য দিয়ে সেই শিল্পচেতনার স্বরূপই উন্মোচিত হয়। বঙ্কিম পেঁচালো রেখা বেয়ে প্রবাহিত হয় সুরের বন্যা। সে সুরে মিশে আছে কেবল দহন, যন্ত্রণা । অন্যদিকে 'টিউন অব ন্যাচা' সিরিজের কাজগুলোতে অনির্বাচনীয় সুরের মুচ্র্ছনা। অর্থাৎ দুটি ধারাই তাঁর কাজে সমান্তরাল- তবে একাকার নয়। সূত্র : কালের কন্ঠ 

এই বিভাগে আরো আছে

স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা 2182544553794853933

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সঙ্গে থাকুন

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক

বৈশিষ্ট্যযুক্ত

বিশ্বসেরা ১০ কার্টুনিস্ট

শিল্পী রফিকুননবী সাধারণ মানুষের কাছে যতটা না তার ফাইন আর্টসের জন্য পরিচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় তার ‘টোকাই’ কার্টুন চরিত্রের জন্য। এ ...

-

  • ফেসবুকে অনুসরণ করুন

    আঁকা-আঁকি আহ্ববান

    আপনার আঁকা, মজার মজার লেখা, ছবি আঁকার কলা-কৌশল, শিল্পীর জীবনী, প্রবন্ধ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অথবা প্রদর্শনীর সংবাদ টুনস ম্যাগে ছাপাতে চাইলে পাঠিয়ে দিন। আমাদের ইমেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।

    সহায়তা করুন

    item