একজন ভাষা সৈনিক চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট মুর্তজা বশীর
বিডি.টুনসম্যাগ.কম শিল্পী মুর্তজা বশীর/ ছবি : সংগৃহীত মুর্তজা বশীর একজন ভাষা সৈনিক, বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট। তিনি ভাষা আন...
https://bd.toonsmag.com/2015/02/20839.html
বিডি.টুনসম্যাগ.কম
মুর্তজা বশীর একজন ভাষা সৈনিক, বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট। তিনি ভাষা আন্দোলনের জন্য অনেক কার্টুন এবং ফেস্টুন এঁকেছেন। তার কার্টুন গুলোতে দেশ ও ভাষার জন্য লড়াই এবং ত্যাগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
ভাষা সৈনিক মুর্তজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট। তাদের আদি বাড়ি ছিল চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে। তার বাবা ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মা মরগুবা খাতুন।
'বিমূর্ত বাস্তবতা' ধারণার প্রবর্তক শিল্পী মুর্তজা বশীর 'দেয়াল', 'শহীদ শিরোনাম', 'পাখা' ইত্যাদি শিরোনামে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রমালা রচনা করেছেন। ফিগারেটিভ কাজেও দেখিয়েছেন নিজের দক্ষতা। 'রক্তাক্ত একুশে' শিরোনামে লিনোকাট মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন নিয়ে এঁকেছেন প্রথম ছবি। পেইন্টিং ছাড়াও ম্যুরাল, ছাপচিত্রসহ চিত্রকলার বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি।
মুর্তজা বশীরের পড়াশুনার হাতেখড়ি বাবার কাছে। তিনি ১৯৪৯ সালে বগুড়া করনেশন ইন্সটিটিউট থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ওই বছরতিনি ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। শৈশবে ছবি আঁকার প্রতি আকর্ষণ থাকলেও, ঠিক শিল্পী হয়ে ওঠার বাসনা তাঁর ছিলনা। চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর পড়াশুনা শুরু হয় কমিউনিস্ট পার্টির দিক নির্দেশনায়। ১৯৪৭ সালে মুর্তজা যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখনই তিনি আকৃষ্ট হন বামপন্থী রাজনীতির প্রতি। কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের জন্য মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের ছবি আঁকতে আঁকতে অংকনে হাতেখড়ি হয় তাঁর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেন ব্যানার শিল্পীদের গ্রাফ করে ছবি আঁকার কৌশল, ঘরে ফিরে করতেন অনুশীলন। তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রখ্যাত নেতা ভবানী সেন ১৯৪৮ সালে বগুড়ায় এসে পার্টি অফিসে বশীরের আঁকা ছবি দেখে তাঁর অটোগ্রাফ বইতে লিখেছিলেন-"আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের ভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভেতর দিয়ে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যাতে সমাজে সে আর্ট নবজীবন সৃষ্টি করতে পারে।" -এই বাণী কিশোর বশীরকে আলোড়িত করেছিল বলেই তিনি হয়েছেন দেশের একজন অন্যতম চিত্রশিল্পী। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে, বগুড়া শহরে আন্দোলনের জন্য বেশ কয়েকটিমিছিল এবং মিটিং আয়োজনে হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান পুলিশ তার নামে মিথা মাললা ৫ মাস কারাগারে আটকে রাখে।
১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনষ্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট)-এ দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে মুর্তজা বশীর চারুকলা শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদী শিল্প শিক্ষা শেষ করে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাকসহ বেশ ক'জন গুণী শিল্পীকে। প্রথম থেকেই বশীর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে তাঁর চিত্রকলার বিষয়বস্তু করেছেন।
হাজং বিদ্রোহের সময় রাস্তার দেয়ালে পোস্টার সাঁটার সময় মুর্তজা বশীর পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। পাঁচ মাস জেলে বন্দী থেকে জামিনে বের হয়ে ছবি আঁকার প্রতি একেবারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরে জয়নুল আবেদীনের পরামর্শে আগ্রহ ফিরে পান তিনি। এরপর পাঁচ মাসের ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য তিনি আমিনুলের বাড়ীতে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন সাহচর্যে ড্রইং করেছেন ও তেলচিত্র এঁকেছেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং গুলিবিদ্ধ আবুল বরকতকে আরও অন্যান্য সহযোদ্ধার সাথে হাসপাতালে নিয়ে যান। ১৯৫৪ সালে ফাইন আর্টের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল বেরোবার আগেই তিনি কলকাতায় আশুতোষ মিউজিয়ামে চার মাসের একটি আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে যোগ দেন। বশীর এখানেই প্রথম পাশ্চাত্য আর্টের ইতিহাস, ভারত শিল্পের ইতিহাস, শিল্পের তত্ত্ব ও নান্দনিকতা বিষয়ে শিক্ষার সুযোগ পান। এখানে তিনি অর্দ্ধেন্দু কুমার গাঙ্গুলী, বাগেশ্বরী অধ্যাপক কল্যাণকুমার গাঙ্গুলী, মিউজিয়াম কিউরেটর দেবপ্রসাদ ঘোষ, ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্ত প্রমুখ গুণী ব্যক্তিদেরকে শিক্ষক হিসেবে পান। কলকাতায় চার পাঁচ মাসের প্রবাসজীবনের সময় তিনি উপন্যাস লেখায় হাত দেন। ১৯৭৯ সালে তাঁর একটি আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ 'আলট্রিমেরিন' প্রকাশিত হয়।
১৯৫৬ সালে মুর্তজা বশীর উচ্চতর শিক্ষার জন্য বাবার অর্থে ইতালীর ফ্লোরেন্সে যান। আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি আর্টিতে এক বছর চিত্রকলা এবং আরেক বছর ফ্রেসকো নিয়ে পড়াশোনা করেন। ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর ঐতিহ্য তাঁকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করেছে, তাঁর শিল্পকর্মের ভিত্তিকে করেছে শক্তিশালী । এ সময় অধ্যাপক কাপুকিনি ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তাঁর কাজে ফিগারের সরলীকরণ ও নূন্যতম রঙ ব্যবহারের শৈলী বশীরকে আকৃষ্ট করেছিল। ফ্লোরেন্সে বশীর পথে প্রান্তরে দেখা সাধারণ মানুষের ছবি এঁকেছেন। ইতালিতে দু'বছর কাটিয়ে ১৯৫৮ সালের শেষদিকে তিনি লন্ডন হয়ে দেশে ফেরেন। ফ্লোরেন্স ছেড়ে আসার আগে মুর্তজা বশীরের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল 'লা পার্মানেন্ট' গ্যালারীতে। এতে ফ্লোরেন্সে অবস্থানকালীন আঁকা চৌদ্দটি তৈলচিত্র ছিল। ১৯৫৮ সালে বশীর ইতালিয়ান চিত্রকর রাপিসার্দি ও ভাস্কর ম্যাডোনিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে 'মুভিমেন্টো প্রিমোরডিও' (আদিমতার আন্দোলন) নামে একটি শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে তোলেন এবং ফ্লোরেন্সের অদূরে এম্পোলি শহরে গ্রুপ প্রদর্শনী করেন ১৯৫৮ সালের ১৩ থেকে ২৫ এপ্রিল । লন্ডনে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যান কিন্তু ছ'মাস কাটিয়ে বাবার আদেশে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। লন্ডনে জীবিকা নির্বাহের জন্য নানা কাজ করতে হতো বলে তেমন একটা ছবি আঁকতে পারেননি। এ সময় তিনি বিবিসি'র বাংলা অনুষ্ঠান 'আন্জুমান'- এ খবর ও অন্যান্য কথিকায় অংশগ্রহণ করেন এবং সেসময় তিনি লন্ডন প্রবাসী বন্ধু ফজলে লোহানীর উৎসাহে লাইব্রেরীতে বই পড়েছেন আর এভাবেই সমসাময়িক ইংরেজী সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ জন্মায়।
১৯৫৯-এর মে মাসে আমেরিকান ফ্রেন্ডস অব মিডল ইস্ট সংস্থার উদ্যোগে তাঁদের অফিসে ফ্লোরেন্স ও করাচীতে আঁকা বশীরের ২৪টি ছবি নিয়ে একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাঁর বাবা উপস্থিত ছিলেন। করাচীতে এটি ছিল কোন বাঙালি শিল্পীর প্রথম একক আয়োজন। সেই সময় তাঁর কাজ শিল্পী ও শিল্পের সমঝদারদের মধ্যে বেশ আলোচিত হয়েছে।
১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় প্রেসক্লাবে ফ্লোরেন্স ও করাচীতে আঁকা ২০টি ছবি নিয়ে তাঁর পরবর্তী প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। প্রদর্শনী চলাকালে বিশিষ্ট উর্দু কবি ও শিল্পরসিক ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ঢাকা এসেছিলেন। তিনি তখন পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল লাহোর শাখার সচিব ছিলেন। বশীরকে তিনি লাহোরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তাঁর আমন্ত্রণে বশীর লাহোরে গেলেন। ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল লাহোরের 'আল হামরায়' প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল-'পেইন্টিংস, ড্রয়িং এ্যান্ড লিথোগ্রাফস বাই মুর্তজা বশীর'। প্রদর্শিত ৩০টি পেইন্টিংয়ের অর্ধেক ফ্লোরেন্সে, বাকী অর্ধেক করাচীতে আঁকা। এছাড়া জয়নুল আবেদিনের উপদেশে ৬টি লিথোগ্রাফও এঁকেছিলেন তিনি যা এই প্রদর্শনীর অংশ ছিল। বশীরের ছবিতে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি দর্শক সমালোচকদের আকৃষ্ট করে এবং তাঁরা শিল্পীর কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ১৯৬১ সালের জুনে লাহোরে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলে বশীরের সমসাময়িক চিত্রকর্মের দ্বিতীয় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। লাহোরে আঁকা আটাশটি ছবির এই প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলো পাখির মটিফ নিয়ে আঁকা।
১৯৬৭ সালের আগষ্টে সারগোদায় 'দেয়াল' সিরিজের আঁকা ২১টি তৈলচিত্র নিয়ে লাহোরে ও সেপ্টেম্বরে রাওয়ালপিন্ডিতে দু'টি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। 'দেয়াল' সিরিজের সর্বশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭০ সালের জানুয়ারী মাসে করাচীতে। এ প্রদর্শনীতে ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আঁকা ৩৯টি ছবি প্রদর্শিত হয়। ১৯৬৮ সালে তাঁর একটি রেট্রোস্পেক্টিভ আয়োজিত হয় ঢাকায় ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত আঁকা চিত্রকর্ম দিয়ে। ৫৭টি পেইন্টিং এবং ৩২টি ড্রয়িং স্থান পায় এতে।
১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্বাধীনতার দাবিতে আয়োজিত বাংলাদেশ চারু ও কারুশিল্পীদের মিছিলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। গ্রেপ্তার হতে পারেন এমন আশংকার কথা জেনে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে সপরিবারের দেশত্যাগ করে প্যারিসে চলে যান। সেখানে মোজাইক ও এচিং-এর প্রশিক্ষণ নেন। প্যারিসে 'দেয়াল' সিরিজের ১৬টি ছবি এঁকে সমাপ্তি টানেন তিনি। তারপর একদিন বাসার উঠোনে নুড়ি পাথর তুলে তার ভেতরকার বিন্যাস, শুদ্ধ ও সরল রূপ অবলোকন করে ভাবলেন-এই রূপের শুদ্ধতাই হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের এপিটাফ। সে সময় প্যারিসে তিনি 'এপিটাফ' নামে এই সিরিজের ১১টি ছবি এঁকেছেন । বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এবং হানাদারদের আক্রমণ কেন্দ্রিক ৮টি ড্রয়িংও করেছেন তখন।
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় বশীর জনতা ব্যাংকে মুরাল আঁকার জন্য প্যারিস থেকে লন্ডন যান। প্যারিসে থাকাকালীন ক্যানে-স্যুর মে শহরে এক চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। দেশে ফিরে ১৯৭৩ সালের আগস্টে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। চট্টগ্রামে তিনি ১৯৭৬ সালের মার্চের মধ্যে 'এপিটাফ' সিরিজে আরো ২০টি ছবি আকেঁন। ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসাবে অবসর নিয়েছেন। চট্টগ্রামে তিনি সহপাঠী শিল্পী রশীদ চৌধুরী ও বন্ধু দেবদাস চক্রবর্তীকে পেয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষকতা ও শিল্পী জীবনের বিকাশের জন্য তিনি চট্টগ্রামকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। প্রায় তিনদশক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি ও বসবাস শেষে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুর্তজা বশীর সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৭৬ সালে মে মাসে ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে 'এপিটাফ ফর দি মার্টায়ারস' শিরোনামে তাঁর একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। এসব চিত্রকর্মে শহীদদের আত্মত্যাগকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হয়েছে। মৃত্যু এখানে হয়েছে মহান ও গৌরবময়। এসব কাজের লিরিক ধর্মিতা লক্ষ্য করে কবি শামসুর রাহমান এগুলোকে 'পাথরের কবিতা' এবং সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত 'আত্মাকে প্রসারিত করার মহাকাব্য' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া তাঁর আরও অনেক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে।
১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রে তিনি সমাজ বাস্তবতা ও শিল্পীত রুচির স্বাক্ষর রেখেছেন। 'নদী ও নারী'র সঙ্গে তিনি আদ্যোপান্ত জড়িয়ে ছিলেন চিত্রনাট্য' সংলাপ লেখক, শিল্প নির্দেশক ও প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে। কারওয়াঁ চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ তাঁর লেখা। 'ক্যায়সেকহু' চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এসবের পূর্বে ১৯৬১ সালে লাহোরে থাকাকালীন চলচ্চিত্রকার ডাব্লিউ. জেড. আহমেদের সহকারী রূপে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৮০'র দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মিউজিয়ামে সংগ্রহ কমিটির দায়িত্বপালন করতে যেয়ে প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ ও গবেষণায় আকৃষ্ট হন মুর্তজা বশীর। ১৯৮৯ সালে জার্নাল অর ল্যুমেসমেটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া নামে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত জার্নালে তাঁর সুলতানী আমলের মুদ্রা সংক্রান্ত ৬টি প্রবন্ধ ছাপা হয়। হাবশী সুলতানদের বিষয়ে বিশদ কোন প্রকাশনা না থাকায় তিনি এ বিষয়ে উৎসাহী হয়ে লেখেন- যা ২০০৪ সালের একুশে বইমেলায় 'মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ' গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বিভিন্ন চারুকলা প্রদর্শনীতে জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ্ বাংলাদেশ ও বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য।
তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে বাংলা ১৪০০ বছর উপলক্ষে চট্টগ্রাম আইনজীবী সহকারী সমিতি কর্তৃক সম্মাননা, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম ইয়ুথ কয়ার প্রদত্ত একুশে মেলা পদক, ২০০৩ সালে সুলতান স্বর্ণপদক, ২০০৭ সালে কবি চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদকসহ আরও বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মান অর্জন করেছেন তিনি।
আর্টস কাউন্সিল অফ পাকিস্তান, করাচী ও পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল, লাহোর; জাতীয় আর্ট গ্যালারি, ঢাকা; বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর, চট্টগ্রাম; বাংলাদেশ দূতাবাস, প্যারিস, ফ্রান্স, ব্রাসেলস্, বেলজিয়াম; জুট ট্রেডিং কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ জুট মিলস্ কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ বিমান, ঢাকা; বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস্ কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থা, ঢাকা; বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা; বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, ঢাকা; ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা; পূবালী ব্যাংক, ঢাকা; জনতা ব্যাংক, ঢাকা; উত্তরা ব্যাংক, ঢাকা; আরব বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা; ইউসিবিএল ব্যাংক, ঢাকা; ব্র্যাক, ঢাকা; র্যাংগস লিমিটেড, ঢাকা; ডানকান ব্রাদার্স, ঢাকা; এ্যাডকম, ঢাকা; সাইনেজ, ঢাকা; শামস্ গ্রুপ, ঢাকা; শিল্প মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং দেশ-বিদেশে ব্যক্তিগত সংগ্রহে তাঁর চিত্রকলা সংরক্ষিত রয়েছে।
শিল্পী মুর্তজা বশীর ১৯৬২ সালে ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম আমিনা। তাঁর দুই কন্যা যুঁই ও যূথি এবং একমাত্র পুত্র যামী।
মুর্তজা বশীর মূলত চিত্রশিল্পী হলেও সংস্কৃতির অন্যান্য শাখায়ও তিনি বিচরণ করেছেন। বিশেষ করে সাহিত্য সাধনায় এবং চলচ্চিত্র শিল্পে তিনি অনেকটা সময় সক্রিয় থেকেছেন। চিত্রকলায় তিনি বাস্তববাদী ও সমাজমনষ্ক হলেও সাহিত্যে তিনি অনেক রোম্যান্টিক। তবে তাঁর ছোটগল্পের ক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সমাজ বাস্তবতার প্রাধান্য দেখা যায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে- গল্পগ্রন্থ 'কাঁচের পাখির গান' (১৯৬৯), উপন্যাস 'আলট্রামেরিন (১৯৭৯), কবিতাগ্রন্থ- 'এসরেণু' (১৯৭৬), 'তোমাকেই শুধু' (১৯৭৯) এবং 'এসো ফিরে অনসূয়া' (১৯৮৫) ও নির্বাচিত রচনা 'মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত' (২০০১)।
শিল্পী মুর্তজা বশীর/ ছবি : সংগৃহীত |
মুর্তজা বশীর একজন ভাষা সৈনিক, বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট। তিনি ভাষা আন্দোলনের জন্য অনেক কার্টুন এবং ফেস্টুন এঁকেছেন। তার কার্টুন গুলোতে দেশ ও ভাষার জন্য লড়াই এবং ত্যাগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
ভাষা সৈনিক মুর্তজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট। তাদের আদি বাড়ি ছিল চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে। তার বাবা ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মা মরগুবা খাতুন।
'বিমূর্ত বাস্তবতা' ধারণার প্রবর্তক শিল্পী মুর্তজা বশীর 'দেয়াল', 'শহীদ শিরোনাম', 'পাখা' ইত্যাদি শিরোনামে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রমালা রচনা করেছেন। ফিগারেটিভ কাজেও দেখিয়েছেন নিজের দক্ষতা। 'রক্তাক্ত একুশে' শিরোনামে লিনোকাট মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন নিয়ে এঁকেছেন প্রথম ছবি। পেইন্টিং ছাড়াও ম্যুরাল, ছাপচিত্রসহ চিত্রকলার বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি।
মুর্তজা বশীরের পড়াশুনার হাতেখড়ি বাবার কাছে। তিনি ১৯৪৯ সালে বগুড়া করনেশন ইন্সটিটিউট থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ওই বছরতিনি ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। শৈশবে ছবি আঁকার প্রতি আকর্ষণ থাকলেও, ঠিক শিল্পী হয়ে ওঠার বাসনা তাঁর ছিলনা। চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর পড়াশুনা শুরু হয় কমিউনিস্ট পার্টির দিক নির্দেশনায়। ১৯৪৭ সালে মুর্তজা যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখনই তিনি আকৃষ্ট হন বামপন্থী রাজনীতির প্রতি। কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের জন্য মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের ছবি আঁকতে আঁকতে অংকনে হাতেখড়ি হয় তাঁর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেন ব্যানার শিল্পীদের গ্রাফ করে ছবি আঁকার কৌশল, ঘরে ফিরে করতেন অনুশীলন। তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রখ্যাত নেতা ভবানী সেন ১৯৪৮ সালে বগুড়ায় এসে পার্টি অফিসে বশীরের আঁকা ছবি দেখে তাঁর অটোগ্রাফ বইতে লিখেছিলেন-"আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের ভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভেতর দিয়ে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যাতে সমাজে সে আর্ট নবজীবন সৃষ্টি করতে পারে।" -এই বাণী কিশোর বশীরকে আলোড়িত করেছিল বলেই তিনি হয়েছেন দেশের একজন অন্যতম চিত্রশিল্পী। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে, বগুড়া শহরে আন্দোলনের জন্য বেশ কয়েকটিমিছিল এবং মিটিং আয়োজনে হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান পুলিশ তার নামে মিথা মাললা ৫ মাস কারাগারে আটকে রাখে।
১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনষ্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট)-এ দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে মুর্তজা বশীর চারুকলা শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদী শিল্প শিক্ষা শেষ করে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাকসহ বেশ ক'জন গুণী শিল্পীকে। প্রথম থেকেই বশীর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে তাঁর চিত্রকলার বিষয়বস্তু করেছেন।
হাজং বিদ্রোহের সময় রাস্তার দেয়ালে পোস্টার সাঁটার সময় মুর্তজা বশীর পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। পাঁচ মাস জেলে বন্দী থেকে জামিনে বের হয়ে ছবি আঁকার প্রতি একেবারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরে জয়নুল আবেদীনের পরামর্শে আগ্রহ ফিরে পান তিনি। এরপর পাঁচ মাসের ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য তিনি আমিনুলের বাড়ীতে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন সাহচর্যে ড্রইং করেছেন ও তেলচিত্র এঁকেছেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং গুলিবিদ্ধ আবুল বরকতকে আরও অন্যান্য সহযোদ্ধার সাথে হাসপাতালে নিয়ে যান। ১৯৫৪ সালে ফাইন আর্টের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল বেরোবার আগেই তিনি কলকাতায় আশুতোষ মিউজিয়ামে চার মাসের একটি আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে যোগ দেন। বশীর এখানেই প্রথম পাশ্চাত্য আর্টের ইতিহাস, ভারত শিল্পের ইতিহাস, শিল্পের তত্ত্ব ও নান্দনিকতা বিষয়ে শিক্ষার সুযোগ পান। এখানে তিনি অর্দ্ধেন্দু কুমার গাঙ্গুলী, বাগেশ্বরী অধ্যাপক কল্যাণকুমার গাঙ্গুলী, মিউজিয়াম কিউরেটর দেবপ্রসাদ ঘোষ, ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্ত প্রমুখ গুণী ব্যক্তিদেরকে শিক্ষক হিসেবে পান। কলকাতায় চার পাঁচ মাসের প্রবাসজীবনের সময় তিনি উপন্যাস লেখায় হাত দেন। ১৯৭৯ সালে তাঁর একটি আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ 'আলট্রিমেরিন' প্রকাশিত হয়।
'রিভিউ' ২০১৪, মুর্তজা বশীর |
১৯৫৬ সালে মুর্তজা বশীর উচ্চতর শিক্ষার জন্য বাবার অর্থে ইতালীর ফ্লোরেন্সে যান। আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি আর্টিতে এক বছর চিত্রকলা এবং আরেক বছর ফ্রেসকো নিয়ে পড়াশোনা করেন। ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর ঐতিহ্য তাঁকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করেছে, তাঁর শিল্পকর্মের ভিত্তিকে করেছে শক্তিশালী । এ সময় অধ্যাপক কাপুকিনি ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তাঁর কাজে ফিগারের সরলীকরণ ও নূন্যতম রঙ ব্যবহারের শৈলী বশীরকে আকৃষ্ট করেছিল। ফ্লোরেন্সে বশীর পথে প্রান্তরে দেখা সাধারণ মানুষের ছবি এঁকেছেন। ইতালিতে দু'বছর কাটিয়ে ১৯৫৮ সালের শেষদিকে তিনি লন্ডন হয়ে দেশে ফেরেন। ফ্লোরেন্স ছেড়ে আসার আগে মুর্তজা বশীরের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল 'লা পার্মানেন্ট' গ্যালারীতে। এতে ফ্লোরেন্সে অবস্থানকালীন আঁকা চৌদ্দটি তৈলচিত্র ছিল। ১৯৫৮ সালে বশীর ইতালিয়ান চিত্রকর রাপিসার্দি ও ভাস্কর ম্যাডোনিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে 'মুভিমেন্টো প্রিমোরডিও' (আদিমতার আন্দোলন) নামে একটি শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে তোলেন এবং ফ্লোরেন্সের অদূরে এম্পোলি শহরে গ্রুপ প্রদর্শনী করেন ১৯৫৮ সালের ১৩ থেকে ২৫ এপ্রিল । লন্ডনে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যান কিন্তু ছ'মাস কাটিয়ে বাবার আদেশে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। লন্ডনে জীবিকা নির্বাহের জন্য নানা কাজ করতে হতো বলে তেমন একটা ছবি আঁকতে পারেননি। এ সময় তিনি বিবিসি'র বাংলা অনুষ্ঠান 'আন্জুমান'- এ খবর ও অন্যান্য কথিকায় অংশগ্রহণ করেন এবং সেসময় তিনি লন্ডন প্রবাসী বন্ধু ফজলে লোহানীর উৎসাহে লাইব্রেরীতে বই পড়েছেন আর এভাবেই সমসাময়িক ইংরেজী সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ জন্মায়।
১৯৫৯-এর মে মাসে আমেরিকান ফ্রেন্ডস অব মিডল ইস্ট সংস্থার উদ্যোগে তাঁদের অফিসে ফ্লোরেন্স ও করাচীতে আঁকা বশীরের ২৪টি ছবি নিয়ে একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাঁর বাবা উপস্থিত ছিলেন। করাচীতে এটি ছিল কোন বাঙালি শিল্পীর প্রথম একক আয়োজন। সেই সময় তাঁর কাজ শিল্পী ও শিল্পের সমঝদারদের মধ্যে বেশ আলোচিত হয়েছে।
১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় প্রেসক্লাবে ফ্লোরেন্স ও করাচীতে আঁকা ২০টি ছবি নিয়ে তাঁর পরবর্তী প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। প্রদর্শনী চলাকালে বিশিষ্ট উর্দু কবি ও শিল্পরসিক ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ঢাকা এসেছিলেন। তিনি তখন পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল লাহোর শাখার সচিব ছিলেন। বশীরকে তিনি লাহোরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তাঁর আমন্ত্রণে বশীর লাহোরে গেলেন। ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল লাহোরের 'আল হামরায়' প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল-'পেইন্টিংস, ড্রয়িং এ্যান্ড লিথোগ্রাফস বাই মুর্তজা বশীর'। প্রদর্শিত ৩০টি পেইন্টিংয়ের অর্ধেক ফ্লোরেন্সে, বাকী অর্ধেক করাচীতে আঁকা। এছাড়া জয়নুল আবেদিনের উপদেশে ৬টি লিথোগ্রাফও এঁকেছিলেন তিনি যা এই প্রদর্শনীর অংশ ছিল। বশীরের ছবিতে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি দর্শক সমালোচকদের আকৃষ্ট করে এবং তাঁরা শিল্পীর কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ১৯৬১ সালের জুনে লাহোরে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলে বশীরের সমসাময়িক চিত্রকর্মের দ্বিতীয় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। লাহোরে আঁকা আটাশটি ছবির এই প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলো পাখির মটিফ নিয়ে আঁকা।
১৯৬৭ সালের আগষ্টে সারগোদায় 'দেয়াল' সিরিজের আঁকা ২১টি তৈলচিত্র নিয়ে লাহোরে ও সেপ্টেম্বরে রাওয়ালপিন্ডিতে দু'টি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। 'দেয়াল' সিরিজের সর্বশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭০ সালের জানুয়ারী মাসে করাচীতে। এ প্রদর্শনীতে ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আঁকা ৩৯টি ছবি প্রদর্শিত হয়। ১৯৬৮ সালে তাঁর একটি রেট্রোস্পেক্টিভ আয়োজিত হয় ঢাকায় ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত আঁকা চিত্রকর্ম দিয়ে। ৫৭টি পেইন্টিং এবং ৩২টি ড্রয়িং স্থান পায় এতে।
১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্বাধীনতার দাবিতে আয়োজিত বাংলাদেশ চারু ও কারুশিল্পীদের মিছিলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। গ্রেপ্তার হতে পারেন এমন আশংকার কথা জেনে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে সপরিবারের দেশত্যাগ করে প্যারিসে চলে যান। সেখানে মোজাইক ও এচিং-এর প্রশিক্ষণ নেন। প্যারিসে 'দেয়াল' সিরিজের ১৬টি ছবি এঁকে সমাপ্তি টানেন তিনি। তারপর একদিন বাসার উঠোনে নুড়ি পাথর তুলে তার ভেতরকার বিন্যাস, শুদ্ধ ও সরল রূপ অবলোকন করে ভাবলেন-এই রূপের শুদ্ধতাই হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের এপিটাফ। সে সময় প্যারিসে তিনি 'এপিটাফ' নামে এই সিরিজের ১১টি ছবি এঁকেছেন । বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এবং হানাদারদের আক্রমণ কেন্দ্রিক ৮টি ড্রয়িংও করেছেন তখন।
‘লির্বাটি নাউ’, ১৯৯১, শিল্পী: মুর্তজা বশীর |
১৯৭৬ সালে মে মাসে ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে 'এপিটাফ ফর দি মার্টায়ারস' শিরোনামে তাঁর একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। এসব চিত্রকর্মে শহীদদের আত্মত্যাগকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হয়েছে। মৃত্যু এখানে হয়েছে মহান ও গৌরবময়। এসব কাজের লিরিক ধর্মিতা লক্ষ্য করে কবি শামসুর রাহমান এগুলোকে 'পাথরের কবিতা' এবং সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত 'আত্মাকে প্রসারিত করার মহাকাব্য' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া তাঁর আরও অনেক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে।
১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রে তিনি সমাজ বাস্তবতা ও শিল্পীত রুচির স্বাক্ষর রেখেছেন। 'নদী ও নারী'র সঙ্গে তিনি আদ্যোপান্ত জড়িয়ে ছিলেন চিত্রনাট্য' সংলাপ লেখক, শিল্প নির্দেশক ও প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে। কারওয়াঁ চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ তাঁর লেখা। 'ক্যায়সেকহু' চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এসবের পূর্বে ১৯৬১ সালে লাহোরে থাকাকালীন চলচ্চিত্রকার ডাব্লিউ. জেড. আহমেদের সহকারী রূপে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৮০'র দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মিউজিয়ামে সংগ্রহ কমিটির দায়িত্বপালন করতে যেয়ে প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ ও গবেষণায় আকৃষ্ট হন মুর্তজা বশীর। ১৯৮৯ সালে জার্নাল অর ল্যুমেসমেটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া নামে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত জার্নালে তাঁর সুলতানী আমলের মুদ্রা সংক্রান্ত ৬টি প্রবন্ধ ছাপা হয়। হাবশী সুলতানদের বিষয়ে বিশদ কোন প্রকাশনা না থাকায় তিনি এ বিষয়ে উৎসাহী হয়ে লেখেন- যা ২০০৪ সালের একুশে বইমেলায় 'মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ' গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বিভিন্ন চারুকলা প্রদর্শনীতে জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ্ বাংলাদেশ ও বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য।
তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে বাংলা ১৪০০ বছর উপলক্ষে চট্টগ্রাম আইনজীবী সহকারী সমিতি কর্তৃক সম্মাননা, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম ইয়ুথ কয়ার প্রদত্ত একুশে মেলা পদক, ২০০৩ সালে সুলতান স্বর্ণপদক, ২০০৭ সালে কবি চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদকসহ আরও বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মান অর্জন করেছেন তিনি।
আর্টস কাউন্সিল অফ পাকিস্তান, করাচী ও পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল, লাহোর; জাতীয় আর্ট গ্যালারি, ঢাকা; বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর, চট্টগ্রাম; বাংলাদেশ দূতাবাস, প্যারিস, ফ্রান্স, ব্রাসেলস্, বেলজিয়াম; জুট ট্রেডিং কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ জুট মিলস্ কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ বিমান, ঢাকা; বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস্ কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থা, ঢাকা; বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা; বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, ঢাকা; ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা; পূবালী ব্যাংক, ঢাকা; জনতা ব্যাংক, ঢাকা; উত্তরা ব্যাংক, ঢাকা; আরব বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা; ইউসিবিএল ব্যাংক, ঢাকা; ব্র্যাক, ঢাকা; র্যাংগস লিমিটেড, ঢাকা; ডানকান ব্রাদার্স, ঢাকা; এ্যাডকম, ঢাকা; সাইনেজ, ঢাকা; শামস্ গ্রুপ, ঢাকা; শিল্প মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং দেশ-বিদেশে ব্যক্তিগত সংগ্রহে তাঁর চিত্রকলা সংরক্ষিত রয়েছে।
শিল্পী মুর্তজা বশীর ১৯৬২ সালে ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম আমিনা। তাঁর দুই কন্যা যুঁই ও যূথি এবং একমাত্র পুত্র যামী।
মুর্তজা বশীর মূলত চিত্রশিল্পী হলেও সংস্কৃতির অন্যান্য শাখায়ও তিনি বিচরণ করেছেন। বিশেষ করে সাহিত্য সাধনায় এবং চলচ্চিত্র শিল্পে তিনি অনেকটা সময় সক্রিয় থেকেছেন। চিত্রকলায় তিনি বাস্তববাদী ও সমাজমনষ্ক হলেও সাহিত্যে তিনি অনেক রোম্যান্টিক। তবে তাঁর ছোটগল্পের ক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সমাজ বাস্তবতার প্রাধান্য দেখা যায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে- গল্পগ্রন্থ 'কাঁচের পাখির গান' (১৯৬৯), উপন্যাস 'আলট্রামেরিন (১৯৭৯), কবিতাগ্রন্থ- 'এসরেণু' (১৯৭৬), 'তোমাকেই শুধু' (১৯৭৯) এবং 'এসো ফিরে অনসূয়া' (১৯৮৫) ও নির্বাচিত রচনা 'মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত' (২০০১)।