লাল টিপ ও দু’টি সিনেমার টিকিট

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান বিডি.টুনসম্যাগ.কম এক. সকালটা বিমূর্ষ হয়ে ঝুলে আছে চেয়ার পোতা বারান্দায়। মাঝে মাঝে বারান্দায় ঘুমান রফিক হাজারী। ...

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
বিডি.টুনসম্যাগ.কম

এক.
সকালটা বিমূর্ষ হয়ে ঝুলে আছে চেয়ার পোতা বারান্দায়। মাঝে মাঝে বারান্দায় ঘুমান রফিক হাজারী। যখন মেহমান আসে তখন নির্বিরোধে-তাকেই এখানে থাকতে হয়। এখানে ঘুমাতে তার অবশ্য খারাপ লাগে না। বরং ভালো লাগে। ঘুম ভাঙ্গলেই চোখে পড়ে বাবার হাতে লাগানো কদম গাছটা। বাবা তাকে আদর করে ডাকতেন কদম্ব বৃক্ষ! বাবা নেই অথচ কদম্ব আছে। অজস্র ফুল ফোটে এমন গাছ দেখতে কার না ভালো লাগে?

ঘুম থেকে উঠেই সোঁদা ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে। রফিক হাজারী বুঝতে পারে না- ঘ্রাণটা কিসের। গভীরভাবে ঘ্রাণটাকে নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নেন বুকে। আহা! বড় ভালো লাগে। সাথে সাথেই বোধগম্য হয়। ঘ্রাণটা কদম ফুলের। মনটা উৎফুল্ল হয়। অদ্ভুত আনন্দ যেনো জেঁকে ধরে দেহের অলিগলিতে। তাই গলাটা মোলায়েম হয় যথাসম্ভব।

: মুখ ধোয়ার পানি দেও শিমুলের মা। শহরে যামু না আজ। ভুলে গ্যাছ? শিমুলের মা রসুই ঘরে লাল আটার রুটি সেঁকছিলেন। সেখান থেকে ঝটিকা জবাব দেন-
: আপনের মাথার কাছেই পানি দিয়া রাখছি সেই ফজরের ওয়াক্ত। আপনের তো ওঠার নাম নাই। বউয়ের কথায় সকালের কোমল রোদ ছিলো না, ছিলো দুপুরের গ্রীষ্ম রোদ্দুর, শিমুলের মার কথার অঙ্গভঙ্গি দেখে রফিক হাজারীর তাই মনে হয। তবু তার প্রতি স্ত্রীর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে দেখে নিজের কাছেই ভালো লাগে। বালিশের পাশ ঘেঁষেই ঘটি থেকে পানি নিয়ে উঠানে মুখ ধুলেন। উঠানের কোণের আমগাছটা থেকে একটা কচি পাতা ছিড়ে মুড়িয়ে নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে চললেন পুকুরপাড়ের দিকে। তখনই মনে হলো, আহ! ফজরের নামাজটা আদায় হইলো না। শত হলেও তিনি মুসলমান। তার ঠিকমত নামাজটা পড়া চাই। পুকুরঘাটে শিমুলও দাঁত মাজছে। রফিক হাজারীকে দেখে শিমুলের মুখখানা হাসি হাসি হয়ে যায়।

: আব্বা তুই আজ শহরে যাবি?
রফিক হাজারী মাথা নাড়েন। মেয়ের বাকি কথা গুলো শুনতে চুপ করে থাকেন।
: আমার জন্য একটা লাল টিপ আনবি?
: কেন রে মা! লাল টিপ কেন? আর কী আনবো?
: শুধুই লাল টিপ। আর কিছু না। তারপর ইতস্তত করে বলে- তিনটা লাল টিপ আনবি?
মেয়ের লাল টিপের বায়না রফিক হাজারী জানেন। কালই শুনেছেন স্ত্রীর মুখে। পাশের বাড়ির রূপালীর একটা লাল টিপ গত পরশু লুকিয়ে রেখেছিলো শিমুল। তাই দেখে রূপালী নাকি ভারি রেগেছে। আচ্ছা করে বকে দিয়েছে শিমুলকে। বার বার সাবধান করে দিয়েছে- পরে যেন শিমুল এমন না কর। সেই থেকে শিমুলের মুখ ভার। লাল টিপ তার চাই চাই! সে যখন লাল টিপ পরে রূপালীর আশেপাশে ঘুরবে তখনই প্রতিশোধ নেয়া হয়ে যাবে শিমুলের। রফিক হাজারীর লাল টিপ আনার স্বীকারোক্তিতে খুশি হয় শিমুল। তার খই ফোটানো মুখে হাসির রেখা ঝিলিক দিতে দেখেন হাজারী। শিমুল ততক্ষণে ব্যস্ত হয়ে রসুই ঘরের দিকে ছুট দেয়। মাকে লাল টিপ কেনার সংবাদ দিতে তার আর তর সয় না যেন।

দুই.
শহরের নাম নাটোর। বনলতা সেনের নাটোর। বড় বাজারে এসে নাটোরের বাস ধরলেন রফিক হাজারী। বাসে চড়তে তার বড় অস্বস্তি। অথচ বাসে চড়ে আজ ভালো লাগছে। ঠিক করে রেখেছেন মেয়ের জন্য আজ দুই ডজন লাল টিপ কিনবেন। মনের ভেতর তবু একটা দ্বিধা জাগে। শুধুই লাল টিপ? কালো কেন যায় না? শিমুলের মার ঘন চুলের রঙের মতো কালো? ঠিক করলেন পারুলের জন্যও একডজন কালো টিপ কিনবেন। মৃদু হাসলেন তিনি। খানিকটা লজ্জা পেলেন যেন। পারুলের বয়স আর কত হবে তেইশ চব্বিশ। ভাবনাগুলোকে জড়ো করে বাইরে তাকিয়ে থাকেন রফিক হাজারী। জানালার পাশেই অস্থায়ী আসন। ঘরের কপাট খোলার মতো করে বাসের জানালাটা একপাশে ঠেলে দেন। কাঁচা রাস্তা থেকে বাস ততক্ষণে পিচঢালা পথে উঠে এসেছে। রাস্তার দু’পাশের বড় বড় বিল দেখতে লাগলেন হাজারী। বর্ষার পানিতে ধানগাছগুলোকে হাবুডুবু খেতে দেখে নিজের মনে হয় তিনিই যেন হাবুডুবু খাচ্ছেন বিলের কোমর সমান পানিতে। তারও দু’ বিঘা ধানক্ষেত পানি একাকার করে দিয়েছে। শিমুলের কথা এক পলকের জন্য মনে পড়ে।

: আব্বা দে আমি একটা ধানগাছ লাগাই।
: রফিক হাজারী একুমুঠো ধানী চারা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ের দিকে।
ধানী চারাগুলো নরম মাটিতে পুঁতে দিতে দিতে শিমুল বলে- এই বার আমাগো অনেক ধান অইব আব্বা, ঠিক না?
কৃষক সেদিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখে হাসি দিয়ে বলেছিলো- ঠিক।
অনেক ধান হয়েছিলো ঠিকই। কিন্তু পাকার আগেই ঘোর বর্ষায় গিলে নিয়েছে বিস্তীর্ণ ক্ষেত। ফসল আর ঘরে তোলা হয় না। আউইস্যা ধানের দুর্দশায় শিমুলের মনটা নিরানন্দ হবে, এই ভেবে নিজের মনটাই খারাপ হয়ে গেলো রফিক হাজারীর। বাসের ভেতর যাত্রীদের একপলক দেখে আবারো বাইরে তাকান হাজারী। রাস্তাটা ব্যাপৃত। গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে টিনের মুড়ির মতো লোকাল বাস। হঠাৎ করেই ঝাঁকি খেয়ে থেমে যায় গাড়িটা। যাত্রী উঠছে বা নামছে বোধহয়। সেদিকে তার খেয়াল নেই। তিনি তাকিয়ে আছেন দূর থেকে ধীর লয়ে রিক্সায় আসতে থাকা একজোড়া মানুষের ওপর। রিক্সার হুড উঠানো। ভেতরে ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছে ছেলেমেয়ে দু’টি। ‘নব দম্পত্তি’ ভাবলেন রফিক হাজারী। প্রেমিক প্রেমিকাও হতে পারে। ওরা হাসছে। হৃদয়ের গভীর জমিন খুঁড়ে বেরিয়ে আসা সুখ অনুভূতির ছোঁয়া বাসকে ছাড়িয়ে চলে যায় সামনে। এক সময় মিলিয়ে যায় বাঁকে। এমন সময় তাদেরও ছিলো। তার আর পারুলের। বিয়ের পর নববধূকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতেন প্রায়ই। কত বার যে গিয়েছেন তার হিসেব নেই। বাড়ির ভাবীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রিক্সায় তুলে দিতেন পারুলকে। ভাবীরা দেখলে মশকরা করার সুযোগ তারা কখনো ছাড়বেন না জানতেন দু’জনই। তাই তো গোপনীয়তা। মাঝে মাঝে যে ধরা পড়তেন না তাও না। দুলালী ভাবীর কাছে ধরা পড়েছিলেন একবার। অনেক আগে। আহা সেদিন লজ্জায় মাটির সাথে যেন মিশে গিয়েছিলো পারুল। ভাবীর তামাশার কথার বহর অনেক দিন গেঁথে ছিলো তার মনে। রফিক হাজারী মনে মনে ঠিক করলেন কাল-পরশু পারুলকে নিয়ে রিকশা করে যাবেন সিনেমা হলে। ঘনিষ্ঠভাবে। সেই আগেরকার দিনের মতো। গোপনে! চেঁচামেচিতে সিনেমা দেখার চিন্তাটা একপাশে সরিয়ে বাসের ভেতর তাকান রফিক হাজারী। বাস আগের জায়গায়ই থেমে আছে। চলছে না। ড্রাইভারের সামনের কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকালেন। জটলা লেগে আছে। ভালো করে তাকিয়েই থমকে গেলেন। চোখের ভেতর ভেসে ওঠলো মোচওয়ালা ড্রাইভার লোকটাকে দু’চারজন লোকের এলোপাথাড়ি পেটানোর দৃশ্য। বাস থেকে নেমেই রহস্যটা বুঝতে পারলেন। একটা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বাসটা। ঘাতক বাস! বাসটা নিশ্চয়ই এখন ভেঙ্গেচুরে ফেলবে স্থানীয়রা। বাঙালির যা স্বভাব! ড্রাইভার লোকটার জন্য এক ধরনের কষ্ট অনুভব করলেন হাজারী। তারপর হাঁটা দিলেন জটলাকে পাশ কাটিয়ে। আরেকটা বাস ধরতে হবে। শহরে জরুরি কাজ পড়ে আছে তার। নাটোর এখান থেকে বেশি দূরে নয়। দুই তিন কিলো। বাসে গেলে কয়েক মিনিট লাগবে। রফিক হাজারী লাল টিপ, সিনেমা হলের ভবিতব্য স্বপ্নগুলো আবারো ঝালিয়ে নেন মনে মনে।

তিন.
শহরের কালু খাঁ দোকানটা চোখে পড়তেই দেহের ভেতর স্বস্তি অনুভব করেন হাজারী। দোকানের নড়বড়ে টুলের ওপর বসে এককাপ চায়ের কথা বলেন দোকানীকে। দুই তিন কিলো পথ হেঁটেই এসেছেন। বাস পাননি। চিনি কম দিয়েন চাচামিয়া। অন্যদিনের মতো কথাটা বলার আগেই দোকানী চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেয়। সাথে থাকে পানমুখো দোকানীর দেতো হাসি। চায়ে চুমুক দিয়ে দেখলেন চিনি ঠিকই আছে। দোকানী কয় ঘটনা শুনছেন? তারপর ঘটনাটা বলে। একটা বাসে আগুন দিয়েচে সিদ্দিকগঞ্জে। নিলয় বাস। ড্রাইভারও মারা যায় যায়। একটা বাছুর নাকি মেরে ফেলেছে বাসটা। হা হা করে হাসে দোকানী। যেন ঘটনা বেশ মজার। চায়ের দাম দিয়ে উঠে পড়লেন হাজারী। চোখে খুঁজছেন চুড়ি-পুতির দোকান। এসব দোকানেই টিপ পাওয়া যাবে। ছোট্ট একটা দোকান পাওয়া যায়। মাদুলী কসমেটিকস। কাচের ভেতর দিয়ে দোকানে সাজিয়ে রাখা টিপগুলো দেখেন। সবুজ নীল কালো টিপ্। দোকানী লালটিপ নাই? নাই। কাইল শেষ হইয়া গেছে। দোকানী জবাব দেয়। বিরক্ত মুখ নিয়ে রফিক হাজারী দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন। তিন দোকান পরের দোকানে লাল টিপ পাওয়া যায়। সাথে কালো টিপও। টিপের নাম চন্দনা। দুই ডজন আর এক ডজন দিও দোকানী। কথা মত কাজ হয়। দামটা দিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। বুকের ভেতর স্বস্তি লাগে। আনন্দও।
টিপগুলো পাঞ্জাবীর ডানপকেটে ঢুকিয়ে কামাল শেখের দোকানের পথে পা চলে। পাঁচ হাজার পাবেন তার কাছ থেকে। ধার নিয়েছেন  বছর হয়ে এলো। আজ আবার তারিখ দিছে। আইজ টাকা না দিলে সে একটা কুত্তার বাচ্চা। বেজন্মা। বলছিলো কামাল শেখ।
শেখের দোকানে আজ একটা ছেলে বসে আছে। শেখ নাই।

: কিরে তোর আব্বা কই?
: ঢাহা গেছে। মাল আনতে।
: কবে গেছে?
: পরশু।
মন মনে কামাল শেখকে বেজন্মা বলে গাল দেন হাজারী। শালা মিথ্যুক। গলাটা কেমন ধরে আসে। ঘরে কুটুম আসছে কালকে। আজ ভালোমন্দ খাওয়াবেন। শহর থেকে পোল্ট্রি মুরগী আর গাওয়া ঘি আনতে  বার বার বলে দিয়েছে পারুল। দিনকাল ভালো না। হাতে পয়সা কড়ি নাই। এখন কেমনে খালি বাড়িতে ফিরবেন তিনি। কুটুম তো আর যেই সেই কুটুম না। বড় কুটুম। বোন জামাই। দু’-চারটা দিন থাকবে। ভালো না খাওয়ালে তার বদনাম হওয়ার কিছু বাকি থাকবে কি? বাস স্টেশনের দিকে পা বাড়াতেই কামাল শেখের মাঝবয়সী ছেলেটা ডাকে, চাচা আব্বা আপনেরে দিতে কিছু টাকা রাইখ্যা গেছে। লিয়া যান। রুমালে মোড়া কিছু টাকা হাজারীর হাতে তুলে দেয় ছেলেটি। গুণে দেকেন টাকা পাঁচ হাজারই আছে। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে একপলক তাকিয়ে থাকেন রফিক হাজারী। মনে মনে দোয়া করেন। তারপর পা বাড়ান খোয়া উঠা পথে। অনেক কেনাকাটা করতে হবে। পকেটে একবার হাত দিয়ে টিপগুলো হাতড়ে দেখেন আছে কিনা। না আছে।

চার.
দু’ একদিন ঝুম বৃষ্টিতে ক্ষেতগুলো মরে গেলো। ফসলও মরল। বৃষ্টির পর মৃদু ঠা-া লাগার কথা। উল্টো আজ দুপুর বেলাই ঘামছে পারুল। মানুষটা শহর গেছে। নিশ্চয়ই গরমে নেয়ে ঘেমে অস্থির হয়ে আছে। শিমুল দাঁড়িয়ে আছে বড় রাস্তার মোড়ে। তার আব্বা এই পথেই আসবে। তার জন্যে সাথে করে আনবে টিপও। লাল টিপ। পারুল শিমুলকে ডাক দেয় বার কয়েক। গোছল কইরা যা শিমুল। শিমুল গোঁয়ারের মতো মোড়ে দাঁড়িয়েই থাকে। মেয়ের দিকে এক লহমা জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে স্বামীর জন্য শরবত বানান পারুল। কাগুজির শরবত। ঘরের ভেতর থেকে ননদী ডাক দেয়। ঘরে ঢোকার আগেই রফিক হাজারীকে রাস্তার মোড়ে দেখা যায়। সাথে শিমুল। হাসছে। রফিক হাজারীর এক হাতে বাজারের ব্যাগ। অন্য হাতে মেয়েটাকে ধরে রেখেছেন। মানুষটা আসতেই শরবতের মগটা এগিয়ে দেন পারুল। ঘেমে ভিজে গেছে হাজারী। পরনের পাঞ্জাবিটা লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। তবু মুখটা হাসি হাসি তার। এমন হাসি মুখ দেখতে বড় ভালো লাগে পারুলের। শিমুল ততক্ষণে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে এনেছে টিপের পাতাগুলো। লাল টিপের সাথে কালো টিপ দেখে শিমুলের ছোট্ট ভ্রু কুচকে উঠে। কালা টিপ আমি নিমু না। বলেই লালটিপের পাতা নিয়ে ঘরের ভেতর উধাও হয়ে যায় সে।
কালো টিপের রহস্য ততক্ষণে বুঝে ফেলে পারুল একটু লজ্জা লাগে তার। রফিক হাজারী চারদিকে এক পলক তাকিয়ে একটা কালো টিপ গুঁজে দেয় পারুলের কপালে। অনেকদিন পর পারুলের শরীরটা ঝনঝনিয়ে ওঠে। স্বামীর দিকে রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে রসুই ঘরের দিকে মিশে যায় সে। অনেক পর সেখান থেকে পারুলের খিলখিল হাসি শোনা যায়। রফিক হাজারী যৌবনের চোখে রসুই ঘরের দিকে পা বাড়ান নিজের অজান্তেই।

পাঁচ.
দাদার হাতে লাগিয়ে যাওয়া কদম গাছটার নিচে কানামাছি খেলছে শিমুল আর রূপালী। শিমুলের কপালের লাল টিপটা আড়চোখে বার বার দেখে রূপালী। কত সুন্দর। রূপালীর মনের ভাব পড়তে পেরে শিমুল হি হি হাসে। আরো তেইশটা টিপ আছে। আব্বা আনছে। বলে শিমুল। তোরে একটাও পরতে দিমু না। আরো বলে চোখ ছোট ছোট করে। তোর সাথে খেলুম না আর। অপমানে কটাক্ষে কাঁদো কাঁদো চোখে নিজেদের বাড়ির দিকে পালিয়ে যায় রূপালী। ততক্ষণে ঘর থেকে পারুলের গলা ভেসে আসে। শিমুল কই তুই? সন্ধ্যা অইল পড়তে বস। মায়ের বকুনি খাওয়ার ভয়ে দ্রুত ঘরের দিকে পা বাড়ায় শিমুল। ঘরের ভেতর মাঝারি খাটটাতে রফিক হাজারী বসে আছেন। মাথায় সিনেমা হল ঘুরছে তার। দোকানে গিয়ে খবর নিয়েছেন নতুন বই নামছে- নায়ক রাজের। সিনেমাটা নাকি বেশ ভালা কাহিনীর। আবছা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে পারুলের দিকে তাকান। মেয়েটাকে পড়াচ্ছে সে। বড় কুটম্ব যত্ন আত্তি নিয়ে বিকেলেই চলে গেছে। সাথে সাথে একটা ভার কমিয়ে দিয়ে গেছেন হাজারীর। হাজারীর চিন্তায় রাত হু হু বাড়ে। এক সময় শিমুল ঘুমিয়ে পড়ে। মেয়েকে মশারী টানিয়ে দিয়ে উঠে আসে পারুল। রফিক হাজারীর গা ঘেঁসে বসে। হাজারী বউয়ের হাত ধরে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, কাইল দুপুরে কাজলীতে সিনেমা দেখতে যাবি? জবাবে পারুলের চোখ চক চক করে। জোনাকী পোকা জ্বলছে যেনো। শিমুলরে স্কুল পাঠাইয়া রেডি থাইকো। রিকশা পাঠামু, টুক কইরা উইঠা পইড়ো। আমি বড় রাস্তা থেইকা উঠুম। কথাগুলো বলেই অন্ধকারে নিঃশব্দে হাসে রফিক হাজারী। পারুলও হাসে। আঁচল চাপা হাসি। পুরানো খাটটা কেবল একবার মড় মড় করে শব্দ তোলে অভিসারের প্রতিবাদ জানায় যেনো। পারুলের নিঃশ্বাস আরো গভীর হয়। গভীর হয় নির্ঘুম রাতও।
পরদিন দুপুরে ঠিক সময়েই রিকশা পাঠায় রফিক হাজারী। নিজে দাঁড়িয়ে থাকে শহরে যাবার বড় রাস্তার নির্জন বাঁকে। রিকশা ড্রাইভারকে বলা আছে সব। মিনিট দশেক পর পারুলসহ রিকশা আসে। সতর্ক চোখে রাস্তার দু’পাশে তাকিয়ে চট করে সিটে উঠে বসে হাজারী। পারুলের গায়ে গা লেগে থাকে। দীর্ঘদিনের পরিচিত শরীরের গন্ধ এসে নাকে লাগে। ত্রিচক্রযান সামনে এগোয় মৃদু ছন্দে। পারুল লজ্জায় বাইরে তাকিয়ে থাকে। দক্ষিণে খরশ্রোতা নদী। কিছু নৌকা এদিক ওদিক ছুটছে। দূর থেকে সুন্দরবন লঞ্চটা আসতে দেখা যায়। বড়লোকের বাংলো বাড়ির  মতো ঝকঝকে সুন্দর লঞ্চটা। বুক পকেট থেকে সিনেমা হলের রঙিন টিকিট দু’টি পারুলের হাতে গুঁজে দেন রফিক হাজারী। আগ্রহ ভরে নতুন কেনা গহনার মতো চকচকে দৃষ্টিতে সেগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেন পারুল। বড় রাস্তায় রিকশা উঠে আসে। ফ্যাঁ কোঁ শব্দে মালবাহী ট্রাকগুলো জোর গতিতে আসা যাওয়া করছে। মুগ্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে পারুল আচমকাই চিৎকার দিয়ে ওঠে। ততক্ষণে প্রচ- ধাক্কা চোখে আঁধার দেখেন হাজারী। একটা বাস চলে যাওয়ার শব্দ হয়। নদীর পানিতেও ঢেউ ওঠে ঝুপ। তীব্র ককানীতে চোখ খোলতে চেষ্টা করেন হাজারী। নদীর পাড় ঘেঁষা ব্লকের কংক্রিটে তার মাথার রক্ত লেপ্টাতে থাকে। স্যাঁতস্যাঁতে গরম রক্ত। নদীতে রিক্সাটা হাবুডুবু খেতে খেতে ডুবে যায়। গদিটা ভাসতে ভাসতে চলে যায় দক্ষিণে।
পারুলকে কোথা দেখা যায় না। মাথাটা শূন্য হওয়ার আগে একবার মনে হয় তার আশেপাশে পারুল নেই। ভাবনাটা থেমে থাকে। তারপর গাঢ় অন্ধকার গভীর কালো ছায়া।

ছয়.
শহরের হাসপাতালে রফিক হাজারী অর্ধমৃত পড়ে থাকে। জ্ঞান ফিরলেও চোখ মেলতে পারেন না তিনি। অস্পষ্ট শিমুলের গলা শোনা যায়। কাঁদছে।
পারুলের লাশটা নদীতে ডুবে গেছে বা ভেসে গেছে। আত্মীয়দের কারো কথাই বিশ্বাস হয় না হাজারীর। ঘুরেফিরে চোখের সামনে শিমুল ঘোরাফেরা করে। আম্মা কই? মেয়েটার এ জাতীয় প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আসে না। নানা বাড়ি কিংবা বেড়াতে গেছে কোথাও মেয়েটাকে মিথ্যা বলতে গিয়ে হাজারীর বুকটা হু হু করে। শিমুল রান্নাবাটি খেলে। স্কুল একদিন যায়, অন্যদিন যায় না। হাজারী তাকে কিছুই বলেন না। বিকেলে কাচুমাচু মুখে শিমুল এসে সামনে দাঁড়ায়। লালটিপগুলো শেখ হয়ে গেছে। শহরে যাবি আব্বা। বলেই বাপের মুখের দিকে তাকায় মেয়েটি। প্রত্যাশিত জবাব চায়। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করেন হাজারী। শিমুলের কপালে একটা লালটিপ সেঁটে আছে। এটাই বোধহয় শেষটা। মা মরা মেয়েটাকে কিছু সুখ দিতে ময়লা পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে শহরের দিকে পা বাড়ান বিপত্নীক। মুখে রাজ্যের চিন্তার চাপ। তবুও বাসে উঠেন নির্ভার মুখে। কি মনে করে মাঝপথেই বাস থেমে নেমে যান তিনি। বাস চলে যেতেই রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাকা নদীটার দিকে একপলক তাকান তিনি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে চলেন তীর ঘেঁষে। বাতাসের ঝাঁপটা এসে মুখে লাগে। পরিচিত একটা ঘ্রাণ যেনো মিশে যায় নিঃশ্বাসের সাথে। পারুলের শরীরের মতো গন্ধ। এ সময় থেমে বসে পড়ে শুকনো রক্তের দাগ পড়া ব্লকের পাশে। তার নিজের রক্ত। সামনে তাকান। সর্বগ্রাসী নদী। হাজারীর চোখ ভিজে আসে।
পারুল! পারুল!
মনের ভেতরের ডাকে কেউ সাড়া দেয় না। বড় রাস্তার দিকে উঠে দাঁড়াতেই একদলা কাগজ চোখে পড়ে। রঙিন কাগজ। টুকরোগুলোর ভাঁজ খুলতে গিয়ে রফিক হাজারীর হাত কাঁপতে থাকে। তার কেনা টিকিট। বহুদিনের আগের ইস্যু করা কাজলী হলের সিনেমার সেই টিকিট দু’টো হাজারীর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে যেনো। রফিক হাজারী টিকিটগুলো বুকের সাথে ঝাঁপটে ধরে শহরের পথ ধরেন।
 

স্টাফ রিপোর্টার
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ, চাঁদপুর।

এই বিভাগে আরো আছে

গল্প 6497154079112432354

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সঙ্গে থাকুন

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক

বৈশিষ্ট্যযুক্ত

বিশ্বসেরা ১০ কার্টুনিস্ট

শিল্পী রফিকুননবী সাধারণ মানুষের কাছে যতটা না তার ফাইন আর্টসের জন্য পরিচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় তার ‘টোকাই’ কার্টুন চরিত্রের জন্য। এ ...

-

  • ফেসবুকে অনুসরণ করুন

    আঁকা-আঁকি আহ্ববান

    আপনার আঁকা, মজার মজার লেখা, ছবি আঁকার কলা-কৌশল, শিল্পীর জীবনী, প্রবন্ধ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অথবা প্রদর্শনীর সংবাদ টুনস ম্যাগে ছাপাতে চাইলে পাঠিয়ে দিন। আমাদের ইমেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।

    সহায়তা করুন

    item